মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন, সেই হত্যাযজ্ঞের মুখেও নিশ্চুপ থাকা এবং এক পর্যায়ে উল্টো সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে বক্তব্য দেয়ায় দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেতা অং সান সু চি তীব্র সমালোচনার মুখে রয়েছেন। এমন অমানবিক অবস্থান নেয়ায় তার বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ মিছিল, র্যালি করে ইতোমধ্যেই সু চি’র নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ার দাবি উঠেছে।
আর এখন জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদকারীদের তীব্র সমালোচনা আর আক্রমণের মুখে পড়েছেন সু চি। নিজের ফেসবুক পেজেই বিভিন্ন পোস্টে কটাক্ষ আর প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে তাকে।
সু চি’র পেজের শুধু কাভার ফটোতেই প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত কমেন্ট বা মন্তব্য পোস্ট হয়েছে সাড়ে ১৭ হাজারের মতো, যার সিংহভাগই করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানিয়ে। কমেন্টগুলোতে প্রশ্ন করা হয়েছে, মানবাধিকারের কথা বলে ক্ষমতায় আসা সু চি কেন এখন মানবতাবিরোধী এমন একটি সরকারি কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন? বলা হয়েছে, সু চি যেন তার নোবেল ফিরিয়ে দেন, কারণ তিনি আর এর যোগ্য নন।
কাভার ফটোতে দেখা যাচ্ছে সু চি শপথ নিচ্ছেন। আলামিন নীরব নামের একজন সেখানে কমেন্ট করেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের মেরে ফেলা হচ্ছে। এখন আপনার মানবিকতা কোথায় গেল? আপনার নোবেল পুরস্কার তাহলে কোন শান্তির কথা বলে? আমরা আপনাকে ঘৃণা করি। এটা একটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ। দ্রুত এসব বন্ধ করুন।
মিয়ানমারের অন্যতম বড় সমর্থক রাষ্ট্র হলো চীন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, মিয়ানমার আসলে অনেক ক্ষেত্রেই চীনের হাতের পুতুল। চীনের সঙ্গে ঠিকঠাক স্বার্থ বজায় রাখার জন্য মিয়ানমার সরকার এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেয় যা নিজ দেশের তুলনায় চীনের জন্য বেশি লাভজনক। সেই সূত্র ধরেই নাসিমুল শুভ ছবির কমেন্টে সু চি’কে চীনা পুতুল বা ‘চাইনিজ ডল’ বলে অভিহিত করেছেন।
সারোয়ার আহমেদ উচ্ছাস নামের এক ব্যক্তি তো তাকে সরাসরি ‘নারী সন্ত্রাসী’ বলে মন্তব্য করেছেন।
ছবিটিতে মন্তব্যকারী সবাই যে রোহিঙ্গা ঢলে আক্রান্ত বা উদ্বিগ্ন বাংলাদেশি তা না। সবাই মুসলিমও নন। কিন্তু নির্যাতন বন্ধের ইস্যুতে তারা প্রায় সবাই-ই একমত। এমনই একজন কমেন্টকারী হলেন কেটি ডাউলিং।
তিনি লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের এখন কী হবে? এটি একটি গণহত্যায় রূপ নিতে যাচ্ছে এবং রূপ নিতে সফলও হবে যদি মিয়ানমার একে ঠেকাতে এখনই কোনো নির্ণায়ক পদক্ষেপ না নেয়। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত অং সান সু চি।’
অবশ্য ভিন্নমতও আছে। যেমন, কেটি ডাউলিংয়ের কমেন্টের প্রথম জবাব দানকারী আল অং নামের এক ব্যক্তি সু চি’র পক্ষ নিয়ে কেটির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। বলেন, ‘আপনারা সুপ্রতিষ্ঠিত, উচ্চশিক্ষিত এবং ধনী একটি গণতান্ত্রিক দেশে বাস করেন যেখানে স্বাধীনতা ও অধিকার রয়েছে। যেখানে ন্যায়বিচার ও ভারসাম্যপূর্ণ আইনের রাজত্ব চলে এসেছে বহু শতাব্দী ধরে। মিয়ানমারে তো এখনো শান্তিই আসেনি। গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিছুদিন আগেও এখানে কোনো নাগরিক বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না। দেশটি খুবই দরিদ্র ও এখনো লড়েই যাচ্ছে। এখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানা সুবিধা একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
আপনাদের উচিত এখানে বৃহৎ স্বার্থটা চিন্তা করা এবং আবেগপ্রবণ হয়ে সু চি’কে আক্রমণ করার আগে ওপরের সবগুলো বিষয় মাথায় রাখা। দয়া করে একটু পড়াশোনা করে দেখুন কীভাবে দখলদার ব্রিটিশরা নির্মমভাবে বার্মিজদের হত্যা করেছিল। তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার?’
এর জবাবে কেটি ডাউনিং সরাসরিই বলেছেন: অতীতে যা হয়েছিল তা অবশ্যই খারাপ ছিল। কিন্তু বর্বরতার শিকার এক গোষ্ঠী পরে আরেক গোষ্ঠীর সঙ্গে একই বর্বর আচরণ করলেও তা যুক্তিযুক্ত হয়ে যায় না। ‘ঠিক যেমন ইহুদি জনগোষ্ঠী নিজেরা অতীতে দমন-পীড়নের শিকার ছিল বলেই তারা ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখতে পারে না। নিজের অতীতকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে অন্যদেরও একই নিষ্ঠুরতার শিকার আপনি করতে পারেন না। একটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু।…… প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বার্মায় বসবাসের পরও তাদেরকে (রোহিঙ্গা) রাষ্ট্রবিহীন হিসেবে বাঁচতে হচ্ছে। আর অং সান সু চি যদি কৌশলী হওয়ার চেষ্টাই করছেন, তবে কেন ক্যামেরায় কেন তাকে ‘অফ দ্য রেকর্ড’-এ মুসলিমবিরোধী কথাবার্তা বলতে দেখা গেল? গণতন্ত্র কখনো একই দেশের মধ্যে এক দলকে অন্য দলের ওপর সুবিধা দেয়ার কথা বলে না।’মিয়ানমার-রোহিঙ্গা-অং সান সু চি
কেটি ডাউনিংয়ের এ বক্তব্যের সমর্থন করেছেন বহু মানুষ। তাদেরও একই কথা। নিজের নির্যাতনের ইতিহাসকে অন্যকে নির্যাতন করার কাজে যুক্তি হিসেবে ব্যবহারকে নিজেরই ইতিহাসকে অসম্মান করা বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে। কেটির কমেন্টে এ পর্যন্ত দেড় হাজারেরও বেশি রিঅ্যাকশন এসেছে।
ইউসুফ সামাদি নামের একজন লিখেছেন, ‘আমি আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি অ্যাডলফ হিটলারের নারী সংস্করণের সঙ্গে: অং সান সু চি।’ এর জবাবে কেউ কেউ বলেছেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খারাপ ঠিকই হচ্ছে। তবে সু চি’কে হিটলার বলাটা আবার বেশি হয়ে যায়। কেউ আবার বলেছেন, হিটলার না, সু চি হলেন নারী মুসোলিনি।
মো ওয়াই নামে মিয়ানমারের একজন ইউসুফ সামাদির এই মন্তব্যের জবাবে বলেছেন, ‘তোমরা মুসলিমরা বারবার মানবাধিকার মানবাধিকার করছো। কিন্তু এমন কিছু মিয়ানমারের আইনে উল্লেখ নেই! আমাদের দেশ মিয়ানমারে মুসলিমদের জন্য জায়গা নেই। সুতরাং তারা মিয়ানমারে থাকতে পারবে না! তোমরা নিজ মাতৃভূমিতে চলে যাও!’
মো ওয়াইয়ের এ ধরণের জবাবের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন বহু মানুষ। কেউ কড়াভাবে, কেউ আবার বুঝিয়ে তার মুসলিম বিদ্বেষী কথার উত্তর দিয়েছেন।মিয়ানমার-রোহিঙ্গা-অং সান সু চি
এছাড়াও অনেকের বক্তব্য ছিল, তারা আগে অং সান সু চি’কে খুব পছন্দ করতেন। এমনকি মানবাধিকারের জন্য লড়াই করা গৃহবন্দী সু চি’কে ভালোও বাসতেন তারা। মানবতার পক্ষে লড়াইয়ের প্রতীক মনে করতেন। কিন্তু এখন সু চি তাদের কাছে ঘৃণিত একটি নাম।
যেমন, করিম হামিদ লিখেছেন, ‘আপনি এতদিন আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন। এখন চলে গেছেন অপছন্দের তালিকায়। রোহিঙ্গাদের প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছেন? আপনি মানুষ নামের কলঙ্ক।’
একইভাবে বিল এডওয়ার্ডস নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘অং সান সু চি – বহু বছর আগে, আমি আপনাকে একজন হিরো হিসেবে গুণগান করতাম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, আপনি একেবারেই ভুয়া একজন মানুষ যিনি ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে আছেন। আর এবার আপনি নিজেকে একজন গণহত্যাকারী দানব হিসেবে প্রকাশ করলেন। এক নারী হিটলার। আপনার স্থান যেন নরকে হয়।’
এভাবে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা, বোঝানো, ধমকানো, তর্কবিতর্ক ছাড়াও রোহিঙ্গাদের বিপদমুক্তি এবং সু চি ও তার সরকারের শুভবুদ্ধির উদয়ের প্রার্থনা জানিয়েও কমেন্ট করেছেন বহু ফেসবুক ব্যবহারকারী।
এমনই আরও অসংখ্য মন্তব্য এসেছে সু চি’র পেজের কাভার ফটোতে। যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অন্যান্য পোস্টগুলোও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
বাংলাদেশ সময় : ১৫০৫ ঘণ্টা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭,
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এ