মিয়ানমারের সঙ্গে ইসরাইলের দস্তি। সেনাবাহিনী যখন অস্ত্র প্রয়োগ করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করছে তখনও মিয়ানমারের এসব সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ দেয়ার দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে ইসরাইল। তারা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করবে না। রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে নির্মূল করে দেয়ার জন্য যে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’ শুরু হয়েছে তাতে তাদের টনক নড়েনি। তারা বলেছে, অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি একান্তই কূটনৈতিক। মিডল ইস্ট আই’কে (এমইই) উদ্ধৃত করে এ খবর জানিয়েছে অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়া।
এতে আরো বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের স্পেশাল বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইসরাইলের টিএআর আইডিয়াল কনসেপ্টের মতো অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। এই রাখাইনেই চলছে ভয়াবহতা। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ও মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলেছে, মিয়ানমারের কাছে ইসরাইল যেসব অস্ত্র বিক্রি করেছে তার মধ্যে রয়েছে শতাধিক ট্যাঙ্ক, বিভিন্ন রকম অস্ত্র, বোট। সীমান্তে এসব বোট ব্যবহার করে পুলিশ। এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের। ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম অ্যাক্ট উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র ওইসব দেশের বিরুদ্ধে এমন নিষেধাজ্ঞা দেয়, যারা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে লঙ্ঘনে জড়িত বা সহ্য করে।
ইউরোপের নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, আভ্যন্তরীণভাবে নিষ্পেষণে ব্যবহৃত হয় এমন অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম মিয়ানমারের কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ। তবে ২৫ শে আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে কমপক্ষে ৪০০ রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাও গত এক সপ্তাহ আগের কথা। এর পর কি পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।
তবে কোনো কোনো মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বলছে, রাখাইনে নিহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি হতে পারে। সেনাবাহিনীর গণধর্ষণ, গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার ফলে আতঙ্কিত, তটস্থ রোহিঙ্গারা বাঁচার আকুতি নিয়ে ছুটে আসছেন বাংলাদেশে। এরই মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছে এক লাখের মতো রোহিঙ্গা। ফলে বাংলাদেশের কাঁধে এখন আড়াই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এ অবস্থায় মঙ্গলবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরাঁ। তিনি বলেছেন, রাখাইনের সহিংসতা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইসরাইলের কাছ থেকে একটি সামরিক শিপমেন্ট অর্ডার করে গত বচর। তখন ওই শিপমেন্ট স্থগিত করতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছিলেন সেখানকার আইনজীবী ও মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা।
তারা দাবি তুলে ধরে বলেছিলেন, মিয়ানমার এখনও সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, ইরানেরবিরুদ্ধে অব্যাহত অবরোধ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ইসরাইল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবরোধ থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে ইসরাইল। এসব অস্ত্র মিয়ানমারে ভয়াবহ অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ বছর জানুয়ারিতে ইসরাইলের কর্মকর্তারা মিয়ানমার সফরে যান। মিয়ানমারের কর্মকর্তারাও ইসরাইল সফরে যান। সেখানে আলোচনা হয় অস্ত্র বিক্রির চুক্তি নিয়ে। ওই সময় ইসরাইলের অধিকার বিষয়ক কর্মীরা একটি পিটিশন দেয় ইসরাইল কর্তৃপক্ষের কাছে। তাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করতে। ওই আবেদনটির শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে এ মাসের শেষের দিকে। কিন্তু প্রাথমিক জবাব দিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা বলেছে, এ ইস্যুতে আদালতের কোনো জুরিকডিকশন নেই। মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি পুরোপুরি কূটনৈতিক।
ইসরাইলের মানবাধিকার কর্মী ওফের নেইম্যান বলেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সময়েই ইসরাইল ও মিয়ানমারের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক ফুলেফেঁপে ওঠে। ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দু’মাস আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইল সফরে যান তখনকার মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। বর্তমানে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানও । তার ওই সফরটি ছিল ইসরাইলের অস্ত্র কারখানাগুলো থেকে অস্ত্র কেনা বিষয়ে। এমন দাবি করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল ইসরাইলের জনপ্রিয় পত্রিকা হারেটজ।
জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের প্রতিনিধিরা সাক্ষাত করেছিলেন ইসরাইলের তখনকার প্রেসিডেন্ট রুভেন রিভলিন ও সেনাপ্রধান সহ সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে। হারেটজ লিখেছে, এ সময় বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, প্রতিরক্ষা বিষয়ক কন্ট্রাক্টর প্রতিষ্ঠান এলবিট সিস্টেম ও এলটা সিস্টেম পরিদর্শন করেন জেনারেল হ্লাইং। ২০১৫ সালের জুনে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বিষয়ক রপ্তানি ডিপার্টমেন্টের প্রধান, জেনারেল মাইকেল বেন বারুচ মিয়ানমার পরিদর্ষন করেন। তখন তিনি মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
ওফের নেইম্যান বলেন, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরাইল চলমান যে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে তার সঙ্গে মিয়ানমার ও ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। এই নীতি ইসরাইলের দমন নীতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তারা ফিলিস্তিনিদের অচ্ছুৎ মনে করে। ফিরিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এটা পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ একটি শাসকগোষ্ঠী। অনেক বিশ্লেষক মিয়ানমারের কাছে ইসরাইলের অস্্রত বিক্রিতে অনাপত্তিতে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/কেএসপি