মিয়ানমার সেনার হত্যাযজ্ঞ, রেহাই পাচ্ছে না রোহিঙ্গা শিশুরাও

মিয়ানমারের সহিংসতা প্রবণ রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী।

স্থানীয় রোহিঙ্গারা এবং অধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, নিরস্ত্র রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করছে মিয়ামারের সেনারা। এমনকি শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না তারা।

তারা আরও অভিযোগ করেন, রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করার পর সেনারা তাদের ঘরবাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

রোববার মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এসব অভিযোগের কথা তুলে ধরা হয়েছে।

এতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বরাতে বলা হয়, গত শুক্রবার ভোররাতে রাখাইনের কিছু পুলিশ চৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) নামে একদল সশস্ত্র ব্যক্তি হামলা চালানোর পর থেকে এ পর্যন্ত একশ’র কাছাকাছি মানুষ নিহত হয়েছে।

শুক্রবারের ঘটনার পর মংডু, বুতিডং এবং রাতেডং জেলাকে ঘিরে ফেলে কথিত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এসব এলাকায় প্রায় আট লাখ মানুষ বসবাস করে। সেনাবাহিনী সেখানে সন্ধ্যা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে।

আল জাজিরা জানায়, রোহিঙ্গা অধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলেছেন গত কয়েক দিনের সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাদের দাবি, অন্তত আটশ’ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েক ডজন নারী ও শিশুও রয়েছে।

তবে শুক্রবারের ভোর রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এ পর্যন্ত মোট কতজন হতাহত হয়েছে তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে আল জাজিরা।

মংডুর বাসিন্দা আজিজ খান বলেন, শুক্রবার সকালে তার গ্রামে অতর্কিত হানা দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, তারা সাধারণের বাড়ি ও গাড়িকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।

তিনি বলেন, সরকারি বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী পুলিশ আমার গ্রামের অন্তত ১১ জনকে হত্যা করেছে। তারা গ্রামে এসে সামনে যা কিছু পেয়েছে তার ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। পরে কিছু সংখ্যক সেনা ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছে উল্লেখ করে আজিজ খান বলেন, এমনকি একটি শিশুও হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি।

ইউরোপ নিবাসী রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার রো নে সান লুইন বলেন, সাম্প্রতিক হামলার সময় পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের বাড়িঘর থেকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

রাখাইনে অবস্থানরত অধিকারকর্মীদের নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে সহিংসতার বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সান লুইন বলেন, বহু মসজিদ ও মাদ্রাসা পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান কোনো খাদ্য ও আশ্রয় ছাড়া ঘটনাস্থলে আটকা পড়ে আছে।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর কারণে আমার নিজের চাচারাও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি গুড়িয়ে দেয়া ও জিনিসপত্র লুট করার পরেও সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য করা হচ্ছে না। খাদ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তাহীন এসব মানুষ জানে না, কখন কাদের হাতে তারা মারা পড়বে।

এদিকে আল জাজিরার কাছে মিয়িন্ট লুইন নামের বুতিডংয়ের একজন বাসিন্দা পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি জানান, লোকজন সামাজিক মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার করছে। এসব ভিডিওতে নারী ও শিশুদের হত্যার দৃশ্য রয়েছে। নিরীহ মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

মিয়িন্ট লুইন বলেন, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না যে আমরা কতটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছি।

তিনি বলেন, কেউই তাদের বাড়ি ছাড়তে চায় না। মুসলমানরা কোথাও যেতে ভয় পাচ্ছে; হাসপাতাল, মার্কেটসহ সব জায়গাতেই আতঙ্ক। এটা খুবই ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি।

সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, কয়েক ডজন পুরুষ, নারী ও শিশু এক কাপড়ে পালিয়ে ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছে।

গত বছরের অক্টোবরে সীমান্ত পুলিশের চৌকিতে সন্দেহভাজন রোহিঙ্গা সশস্ত্র ব্যক্তিরা হামলা চালানোর ঘটনায় নয় পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় অংসান সুচির সরকার রোহিঙ্গা গ্রাম ও পাড়াগুলোতে হাজার হাজার সেনাকে পাঠায়। এতে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমেই ব্যাপকভাবে শোচনীয় হয়ে পড়ে।

অভিযোগ উঠেছে, এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী আক্রমণাত্মক হয়ে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং তাদের হত্যা ও ধর্ষণে মেতে ওঠে। তারা ৮৭ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে পালিয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য করে।

রোববার আল জাজিরাকে ‘ফোর্টিফাই রাইটস’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, সব রোহিঙ্গাকে যোদ্ধা মনে করছে, এর ফলে সহিংসতা তীব্রতর হতে পারে যার জন্য সরকারই দায়ী থাকবে।

তিনি বলেন, রাখাইনের ঘটনা জানার জন্য জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সরকার, অথচ সেখানে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর সেনাবাহিনী আক্রমণ করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যাপক সংখ্যক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, তাদের জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তা প্রয়োজন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি সহজ করছে না।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করে, যাদের বেশিরভাগই দারিদ্রের শিকার এবং প্রচণ্ড বৈষম্যের শিকার।

রোহিঙ্গারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে রাখাইনে বসবাস করে আসলেও এই সংখ্যালঘু জাতিকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী গণ্য করা হয়।

মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীন করে রেখেছে। জাতিসংঘ মনে করে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে দমনাভিযান চালায় তা জাতিগত নিধনের শামিল। তবে অং সান সু চি সরকার এ অভিযোগ ক্রমাগত নাকচ করে আসছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২১ ঘণ্টা, ২৮ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম