শেখ হাসিনাকে নিয়ে কূটনৈতিক উভয় সঙ্কটে মোদি সরকার

কূটনৈতিক উভয় সঙ্কটে ভারত। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিনি বর্তমানে ভারতে রয়েছেন। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার বেকায়দায় পড়েছে। এদিকে তাকে ফেরত পাঠাতে ঢাকা থেকে রাজনৈতিক দাবি উঠেছে। তাকে অব্যাহতভাবে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা সম্পর্কেও সমান সচেতনতা রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে রণধীর জয়সওয়াল ‘বলেন, আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তা হাইপোথিসিসের মধ্যে রয়েছে। এমন হাপোথেটিক্যাল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অভ্যাস আমাদের নেই।’

বাংলাদেশি মিডিয়ার একাংশ যখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়াকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কৌশল হিসেবে তুলে ধরেছে এবং শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারতের সমালোচনা করেছে, তখন উভয় দেশের সিনিয়র রাজনীতিকদের কথোপকথনে এটা বোঝা যায় যে, প্রত্যার্পণ এখন পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে অনুমানভিত্তিক।

শেখ হাসিনা হত্যা থেকে শুরু করে মানবতাবিরোধী কমপক্ষে ১০০ ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টেলিফোনে টেলিগ্রাফের এই প্রতিনিধিকে বলেছেন, ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এখন তাকে (শেখ হাসিনা) ফেরত পাঠাতে বলার দায়িত্ব এবং তাদের সেটা বলা উচিত।’

মির্জা ফখরুল প্রকাশ্যে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে মিটিংয়ে তিনি এ বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারে নেই। কিন্তু তাকে (হাসিনা) ফেরত আনার দাবি জানিয়েছি। তিনি যেসব অপরাধ করেছেন তার সবটার বিচার হতে হবে বাংলাদেশে। আমি জানি না কেন ভারতের কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরেনি অন্তর্বর্তী সরকার।’

মির্জা ফখরুলের মন্তব্য ভারতের এস্টাবলিশমেন্টের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা বলেছে, হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর কোনও অনুরোধ ভারত চাপা দিয়ে রাখেনি। শেখ হাসিনা ভারতেই থাকতে পারবেন না অন্য কোনও দেশে যাবেন এ নিয়ে জল্পনার মধ্যে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খুবই স্বল্প সময়ের নোটিশে ভারতে এসেছেন। এ বিষয়ে আমরা আর বাড়তি কোনও কথা বলব না।’

শেখ হাসিনার সম্ভাব্য প্রত্যার্পণ এবং তিনি কোথায় আছেন এ বিষয়ে নয়া দিল্লিতে ক্ষমতাসীন এস্টাবলিশমেন্টের ভেতরের একজন ব্যক্তি স্পষ্ট ছিলেন। এ বিষয়টিকে আজকের প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্যতম ‘লিঞ্চপিন’ হিসেবে দেখছেন অনেকে। ওই সূত্রটি বলেছেন, বিএনপি (শেখ হাসিনাকে) ফেরত পাঠানোর কথা বলছে। কিন্তু তারা সরকারে নেই। তাকে (হাসিনা) ভারতে অবশ্যই আমন্ত্রণ করে আনা হয়নি। তবে তিনি ভারতে পৌঁছে ঘোষণা দিয়েছেন যে, ভারতকে তাকে গ্রহণ করতে হবে। কারণ, তিনি একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

গত তিন সপ্তাহে বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সারাবিশ্বে, বিশেষ করে ভারতের প্রতি সাধারণ মনোভাব উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিমুক্ত করার নামে বিচারক, সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষকদেরকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এতে মূলত ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামপন্থি দলগুলোর তরুণ নেতৃত্ব ভূমিকা রেখেছে।

প্রফেসর ড. ইউনূস যখন একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তখন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। অনেক সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের মামলার জালে জড়ানো হচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পর একজন সিনিয়র সাংবাদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তিনি বলেছেন, মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা (তরুণ নেতারা ও ইসলামপন্থিরা)। বাংলাদেশে আর কোনও মুক্ত মিডিয়া বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিদ্যমান নেই। কিছু তরুণ নেতা এখন জাতীয় বীর। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারত বিরোধিতা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট তুঙ্গে। এতে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই দুই দেশ নিকট ভবিষ্যতে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখবে কি না।

বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা একমত যে, তরুণ নেতাদের প্রতি এক মাস আগেও জনগণ সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাদের বাড়াবাড়ি জনগণ ভালভাবে নেয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতা বলেন, ‘এসব নেতারা অভিজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ নয়। এটাই অনিশ্চিয়তা সৃষ্টি করছে। এ জন্যই আমরা দ্রুত একটি নির্বাচন দাবি করছি। যাতে নির্বাচিত সরকার দেশ চালাতে পারে এবং তাদের জবাবদিহিতা থাকে।’

ভারতের এস্টাবলিশমেন্টের একটি সূত্র বলেছেন, বাংলাদেশের নতুন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে উদগ্রীব নয়া দিল্লি। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়া অনুকূলে নেই। এটা অনিশ্চিয়তার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো, পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের আইনশৃংখলার কথা মাথায় রেখে পূর্ণাঙ্গ ভিসা সার্ভিস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।

এই প্রতিনিধিকে বিএনপির জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল এমরান সালেহ প্রিন্স বলেছেন, ‘ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের জনগণের যোগাযোগ চাই আমরা। আমরা বিশ্বাস করি এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে হবে সমতা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের নীতির ওপর। আমার প্রশ্ন হলো, (শেখ হাসিনাকে) ভারত আশ্রয় দিয়ে কি বাংলাদেশের জনগণের সংবেদনশীলতায় আঘাত করছে না?’

ভারতীয় অনেক সূত্র বলেছে, তারা বিষয়টি বোঝেন। তবে তাকে (হাসিনা) এই মুহূর্তে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মত নেই। কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, ভারতের জন্য সবচেয়ে ভাল সমাধান হলো শেখ হাসিনার স্বেচ্ছায় অন্য কোনও দেশে চলে যাওয়া। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

নয়া দিল্লির একটি সূত্র বলেছে, তার (হাসিনা) বৃটেন যাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তার সম্ভাব্য বৃটেন যাওয়ার বিষয়টি পররাষ্ট্র সচিবের কাছে উত্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশ হাই কমিশন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও অনানুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু খোঁজখবর নিয়েছে। এই বিষয়গুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

Scroll to Top