মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংঘাতে সংকটে পড়েছেন রোহিঙ্গারা৷ রাজ্যের মংডু ও বুথিডং এলাকায় কয়েকমাস ধরে এই সংঘাত চলছে৷ ঐ দুই শহরের বেশিরভাগ মানুষ রোহিঙ্গা মুসলিম৷ তবে বৌদ্ধরাও সেখানে বাস করেন৷
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ৫ আগস্ট সীমান্তের নাফ নদীর কাছে হামলায় নারী ও শিশুসহ ২০০ জন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন৷ তবে এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি৷
জার্মানির কোলন শহরের এশিয়া হাউস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় জার্মানিতে বসবাসরত তিনজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে ডিডাব্লিউ৷ তারা কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন৷ তাদের সঙ্গে রাখাইনে থাকা পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ রয়েছে৷
তাদের মধ্যে একজন উমর ফারুক জানান, ৪ থেকে ৬ আগস্টের মধ্যে তিনি ১৭ জন আত্মীয়কে হারিয়েছেন৷ প্রাণে বেঁচে যাওয়া দুজন বাংলাদেশে চলে যেতে পেরেছেন বলেও জানান তিনি৷
মুহাম্মদ হুসেইন নামের আরেক রোহিঙ্গা জানান, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জোর করে নিয়োগ করা হচ্ছে, অপহরণ করা হচ্ছে৷ আর অবরোধের কারণে ত্রাণ সহায়তা না পৌঁছানোয় মানুষ বিপদে আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘মানুষকে রাস্তায় বাস করতে হচ্ছে৷ তাদের বাড়িতে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, কিংবা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে৷ পুরো কমিউনিটিতে ক্ষুধা ছড়িয়ে পড়েছে৷ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা দিনে একবারের খাবারই জোগাড় করতে পারছেন না৷ তারা কলার পাতা ও অন্যকিছু খেয়ে বেঁচে আছেন৷”
ফারুক, হুসেইন ও জয়নুল মুস্তফা নামে জার্মানিতে বাস করা আরেক রোহিঙ্গা ডিডাব্লিউকে জানান, তাদের বিশ্বাস ৫ আগস্টের হামলা ও সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আরাকান আর্মি, এএ দায়ী৷
রাখাইনে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে এএ৷ রাখাইনে বাস করা বৌদ্ধদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকান’ ইউএলএ-র সশস্ত্র সংগঠন হচ্ছে এএ৷
এএ ও ইউএল-এর লক্ষ্য, রাখাইনে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলা, যেখানে বৌদ্ধদের পাশাপাশি মুসলিমরাও থাকবেন৷
৭ আগস্ট এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি ৫ আগস্টের হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে৷ বরং তাদের অভিযোগ, হামলার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও ‘কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠী’ দায়ী৷ বিবৃতিতে তিনটি রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর নামও উল্লেখ করা হয়৷ এগুলো হলো ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ বা আরসা, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গ্যানাইজেশন আরএসও এবং আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি এআরএ৷
‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি
ফ্রেঞ্চ স্কুল অফ দ্য ফার ইস্টের লেকচারার ইতিহাসবিদ জ্যাক লাইডার ডিডাব্লিউকে বলেন, রাখাইন শাসন করতে জান্তা সরকার বর্তমানে ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি অনুসরণ করছে৷ যেমনটা ১৯৪৮ সাল থেকে করে আসছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী৷ তারা কোনো এলাকা শাসন করতে সেই এলাকার বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখতো৷
লাইডার জানান, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে জান্তা সরকার জোর করে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা, আইওএম-এর সাবেক সমন্বয়ক পাউল গ্রিনিংস ২০২৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘সামরিক বাহিনী আবারও রাখাইনে এথনিক কার্ড খেলছে৷”
এদিকে, জার্মানিতে বসবাসরত জয়নুল মুস্তফা ডিডাব্লিউকে বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকান আর্মির মনোভাব মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মতো, কিংবা তার চেয়েও খারাপ৷ তারা রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
তবে মুস্তফার এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন ফ্রেঞ্চ স্কুল অফ দ্য ফার ইস্টের লেকচারার লাইডার৷ রাখাইনের অন্য যেসব অংশ আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আছে সেখানে রাখাইনদের সঙ্গে মুসলিম সংখ্যালঘুরা ভালোভাবে বসবাস করছেন বলে জানান তিনি৷