কলকাতায় আরজি কর কাণ্ডের পর নিজে থেকে মামলা হাতে নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় মঙ্গলবার জানিয়েছেন, ‘পরিস্থিতি বদলাতে দেশ আরেকটি ধর্ষণ, হত্যার জন্য অপেক্ষা করতে পারে না।’ তাই নিজে থেকে শুরু করা এই মামলার প্রথম দিনে বেশ কয়েকটি নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
এ দিন দেওয়া নির্দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আরজি করে কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফ নিয়োগ করা হবে।
নিরাপত্তার ভার থাকবে তাদের ওপর। বস্তুত এ দিন শুনানি চলার সময় কলকাতা পুলিশ ও তাদের কাজ নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন ও মন্তব্য করেন বিচারপতিরা। তারপর চিকিৎসকরা যাতে কাজে ফিরতে পারেন, তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত।
এ ছাড়াও প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছেন, তারা দেশের সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করছেন।
সেই টাস্কফোর্সে কারা থাকবেন, সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। এই টাস্কফোর্সের কাছ থেকে তারা কোন বিষয়ে সুপারিশ চান, সেটাও জানিয়েছেন বিচারপতিরা। তা ছাড়া টাস্কফোর্স চাইলে সংশ্লিষ্ট অন্য যেকোনো বিষয়ে সুপারিশ করতে পারবে।
সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার যেন কোনো বিক্ষোভকারীর ওপর তাদের শক্তি প্রয়োগ না করে।
বিক্ষোভ যদি শান্তিপূর্ণ হয়, তাহলে তার ওপর কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা বলেছেন বিচারপতিরা।
আন্দোলনরত চিকিৎসকদের কাছে সর্বোচ্চ আদালতের অনুরোধ, ‘আপনারা এবার কাজে যোগ দিন। এমসের উদাহরণ তুলে তারা বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে এমসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে দুই বছর লেগে যায়। একবার যদি তা বাতিল হয়ে যায়, তাহলে আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘এটা শুধু কলকাতার বিষয় নয়, এটা দেশের সিস্টেম ব্যর্থ হওয়া।
আদালত পুরো দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসক নিয়ে চিন্তিত।’
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে
এদিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এ দিন সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি পেশ করেন কপিল সিবাল। বিচারপতিরা তাকে প্রশ্ন করেন, পুলিশ কখন এফআইআর করে? কপিল সিবাল জানান, বেলা সাড়ো ১২টা নাগাদ পুলিশ আনন্যাচেরাল ডেথ বলে রিপোর্ট দেয়। বিচারপতিরা জানতে চান, কেন রাত পর্যন্ত এফআইআরে হত্যা কথাটা লেখা হলো না? নিহতের পরিবারের হাতে দেহ তুলে দেওয়ার তিন ঘণ্টা পর কেন এফআইআর করা হলো?
বিচারপতিরা বলেন, ‘সৎকারের জন্য মৃতদেহ কখন পরিবারকে দেওয়া হয়? এফআইআর দায়ের হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেহ দিয়ে দিলেন?’
সুপ্রিম কোর্ট জানতে চান, পরের দিন কী করে মানুষ ঢুকে ভাঙচুর করল? পুলিশের কাজ হলো ক্রাইম সিন বা অপরাধের জায়গা রক্ষা করা, কেন তারা সেই কাজে ব্যর্থ হলো? সাত হাজার মানুষ কী করে ঢুকে পড়ল? পুলিশ কী করছিল, তারা কি ভাঙচুরের অনুমতি দিয়েছিল?
সাবেক অধ্যক্ষকে নিয়ে
একই সঙ্গে বিচারপতিরা প্রশ্ন করেন, অধ্যক্ষ কী করছিলেন? তিনি কী করে প্রথমে এটাকে আত্মহত্যা বলেন? হাসপাতাল কেন ঠিক সময় এফআইআর করেনি?
বিচারপতিরা বলেন, ‘আরজি কর থেকে প্রিন্সিপালকে সরিয়ে আরেকটি কলেজের প্রিন্সিপাল করা হলো। তার কাজ কি স্ক্রুটিনি করা হলো? আমরা চাই সিবিআই বৃহস্পতিবার স্টেটাস রিপোর্ট দিক। আমরা সকালে সেই রিপোর্ট দেখব। আমরা দেখতে চাই তদন্ত কোথায় যাচ্ছে। তারপর আমরা নির্দেশ দেব।’
টাস্কফোর্স যা দেখবে
বিচারপতিরা জানিয়েছেন, টাস্কফোর্স দেখবে, কিভাবে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। নারী চিকিৎসক ও কর্মীরা যেন কোনো রকম হেনস্থার মধ্যে না পড়েন। দেখা গেছে, রোগী বা তার আত্মীয়রা অনেক সময়ই সহিংসতার পেছনে থাকেন। তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টাও তারা দেখেবন।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, রাতের ডিউটিতে রেস্টিং স্পেস নেই। ডিউটি রুম আলাদা নেই। ইন্টার্ন, রেসিডেন্টস ও সিনিয়ার রেসিডেন্টস ৩৬ ঘণ্টার ডিউটি করে, টয়লেট অপ্রতুল। অনেক সময়ই চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের থাকার জায়গা হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে। তাদের রাতে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা থাকে না। সুরক্ষা থাকে না। হাসপাতাল থেকে গাড়ি দেওয়া হয় না। সিসিটিভি ক্যামেরা কম। এই সব বিষয় টাস্কফোর্স দেখবে। তারা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলবে। প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পুরুষ ও নারী চিকিৎসক ও কর্মীদের জন্য আলাদা রেস্ট রুম থাকা দরকার। সেখানে পর্যান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তারা সারা দেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চান। সে জন্যই টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে। সে জন্যই আরজি করের ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্ট নিজে হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।