tramp1

অস্ত্র বিক্রি নীতি নিয়ে ট্রাম্প কি অবস্থান বদলাবেন?

পেনসিলভানিয়ার বাটলারে শনিবার এক নির্বাচনি সভায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর গুলি চালানো হয়। গুলি তার ডান কান ছুঁয়ে যায় এবং তিনি মঞ্চে বসে পড়েন। এ ঘটনার পর থেকে আবারও নতুন করে আলোচনায় উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে।

বন্দুকধারীদের নির্বিচার গুলিতে নিরীহ নাগরিকদের মৃত্যুর ঘটনায় বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চলছে আলোচনা। একপক্ষ যেমন এর পক্ষে, তেমনি বিপক্ষেও সরব অনেকে। পুরোনো এ বিতর্ক সামনে এসেছে নির্বাচনি জনসভায় ট্রাম্প আহত হওয়ার ঘটনার পর। কেননা ট্রাম্প বারবার নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে তার জোরালো অবস্থান জানিয়ে আসছেন।

আলোচনায় উঠেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের নীতি বদলাবেন বলে যে অঙ্গীকার করেছিলেন, গুলিতে আহত হওয়ার পর এই রিপাবলিকান কি সেই অবস্থান ধরে রাখবেন?

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বাইডেন প্রশাসনের সর্বশেষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নীতি অনুযায়ী, বর্তমানে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করার সময় ক্রেতার অপরাধের ইতিহাস আছে কিনা এবং তিনি মানসিকভাবে সুস্থ কিনা, বিক্রেতাদের সেটি নিশ্চিত হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। বন্দুকধারীদের গুলিতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে গত ফেব্রুয়ারিতে অস্ত্র অধিকারকর্মীদের সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেছিলেন, আমার অফিসে ফেরার প্রথম সপ্তাহে, সম্ভবত প্রথম দিনই অস্ত্র মালিক ও প্রস্তুতকারকদের ওপর বাইডেনের প্রতিটি আক্রমণ বন্ধ করা হবে।

শনিবার রাতের হামলার পর ট্রাম্প অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে অবস্থান বদলাবেন কিনা, সেই প্রশ্ন যেমন সামনে আসছে; তেমনই এ ঘটনা আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অপরাধ বিজ্ঞান, আইন ও জননীতি বিভাগের অধ্যাপক জেমস অ্যালান ফক্স বলেন, এ ঘটনার পর ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারণায় ‘অস্ত্র সহিংসতা’ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

ট্রাম্পের ওপর হামলাকারীর গুলিতে সমাবেশে আসা এক রিপাবলিকান সমর্থকের প্রাণ গেছে, গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দুজন। পরে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার গুলিতে ওই পুরুষ আততায়ী নিহত হয়েছেন বলে সিক্রেট সার্ভিসের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

অধ্যাপক ফক্স নর্থইস্টার্ন গ্লোবাল নিউজকে বলেন, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যৌক্তিক পদক্ষেপকে সমর্থন করতে চায় না রিপাবলিকান পার্টি। তাদের দলের নেতাকে (ট্রাম্প) গুলি করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হননি। তবে এ ঘটনা অস্ত্র সুরক্ষাব্যবস্থার প্রশ্নে তাদের কিছু অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে অবশ্যই সহায়তা করবে।

নর্থইর্স্টান ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কোসটাস পানাগোপোলাস বলেন, রাজনৈতিকভাবে গুলির এ ঘটনা ট্রাম্পের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ অনেকেই মনে করেন যে, ট্রাম্পই ভোটে সুবিধা নিতে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং বিভাজনের রাজনীতিকে উসকে দিয়েছেন।
নির্বাচনি প্রচার, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আচরণবিধিবিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ অবশ্য পাল্টাটাও ঘটতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, গুলির ঘটনা ট্রাম্পের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সহানুভূতিও তৈরি করতে পারে। কারণ তিনি স্পষ্টতই রাজনৈতিক সহিংসতা এবং চরমপন্থার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

গুলির ঘটনার পর হামলাকারীর বিষয়ে রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা-এফবিআই বলেছে, ট্রাম্পের ওপর হামলাটি করেন ২০ বছর বয়সি টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস। সিক্রেট সার্ভিসের গুলিতে নিহত এ তরুণ ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টিরই সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত।
হামলাকারীর দলীয় পরিচয় এ বিষয়ক আলোচনায় বাড়তি রসদ জুগিয়েছে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে কী করবেন তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা স্মল আর্মস সার্ভের (এসএএস) হিসাবে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ১২০টি করে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা রয়েছে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যেখানে জনসংখ্যার চেয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বা বন্দুকের সংখ্যা বেশি। পরিসংখ্যানে এর পরের অবস্থানে থাকা অঞ্চলটি হচ্ছে ফকল্যান্ড আইল্যান্ড, যেখানে প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ৬২ দশমিক ১০। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক।

২০২০ সালের একটি গ্যালাপ-জরিপের বরাতে সিএনএন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে যারা পরিবার নিয়ে থাকেন তাদের ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের ঘরে অন্তত একটি বন্দুক রাখেন এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশের নিজস্ব মালিকানায় বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র আছে।
ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-অস্টিনের সহযোগী অধ্যাপক জাচ্যারি এলকিনস বলেন, বিশ্বে মাত্র তিন দেশে সাংবিধানিকভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বৈধতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও গুয়েতেমালায়। এর মধ্যে অন্য দুই দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এক-দশমাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক সহিংসতায় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের দাবি জোরালো হলেও ট্রাম্প সবসময়ই তার বিরোধিতা করে এসেছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমার চার বছরের আমলে কিছুই ঘটেনি। অস্ত্র (নিয়ন্ত্রণ) নিয়ে কিছু একটা করতে আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু কিছুই করিনি। আমরা হাল ছাড়িনি। নিজেকে অস্ত্র মালিকদের সেরা বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।

এর আগে ২০২২ সালে হিউস্টনে রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেছিলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনুপস্থিতিতে কখনো সংকট দেখা দিলে এনআরএর প্রশিক্ষিত সদস্যের চেয়ে আপনার আশপাশে আর কেউ থাকে না।
গুলির ঘটনার পর হামলাকারীর বিষয়ে রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা-এফবিআই বলেছে, ট্রাম্পের ওপর হামলাটি করেন ২০ বছর বয়সি টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস। সিক্রেট সার্ভিসের গুলিতে নিহত এ তরুণ ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টিরই সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত।

অতীত অভিজ্ঞতা যা বলছে—
অধ্যাপক অ্যালান ফক্স বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এপি, ইউএস টুডে পত্রিকা ও নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ‘মাস কিলিংস ডেটাবেস’ অর্থাৎ বন্দুক হামলায় গণহারে হত্যার তথ্যভাণ্ডারের প্রধান তত্ত্ববধায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান নেতা রোনাল্ড রিগ্যানকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার পর তার জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র আইন কঠোর করার পক্ষে জনসমর্থন বেড়েছিল।

ঘরের নিরাপত্তা, ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র রাখার পক্ষে প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে রিপাবলিকান পার্টির। এরপরও নিজে বন্দুক হামলার শিকার হওয়ার পর রিগ্যানও তখন ব্যক্তির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার আইনে কড়াকড়ি আরোপে সম্মত হয়েছিলেন।

২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি অ্যারিজোনা রাজ্যের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা গ্যাবি জিফোর্ডসকে গুলির ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র আইন সংশোধন করার পক্ষে জোর দাবি উঠেছিল। জিফোর্ডস নিজেও একজন ‘অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ অধিকারকর্মী’ ছিলেন।

বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রণমূলক কিছু পদক্ষেপ নিলেও আইন করে নাগরিকের কাছে অস্ত্র রাখার বিধান বাতিল করতে ব্যর্থ হন।

স্কুলে স্কুলে বন্দুক হামলায় শিশুদের গণহারে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকবার কাঁদতে দেখা গেছে ওবামাকে। ওই অবস্থায় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াদাও করতে দেখা গেছে তাকে। তবে রিপবালিকানদের বিরোধিতায় আইন পাশ করাতে পারেননি তিনি। ট্রাম্প সেই রিপাবলিকানদেরই কট্টর অংশের নেতা।

অবশ্য অধ্যাপক ফক্স বলছেন, রিগ্যান ও জিফোর্ডসকে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর যেভাবে অস্ত্র সহিংসতার বিষয়টি সামনে চলে এসেছিল, ট্রাম্পের ঘটনার বেলাতেও তেমনি সেটি আলোচনার শীর্ষে উঠে আসবে।

ক্ষমতায় থাকাবস্থায় বন্দুক হামলার শিকার হওয়া শেষ প্রেসিডেন্ট রিগ্যান। ট্রাম্প সাবেক প্রেসিডেন্ট, তবে আবার তিনি ভোটে লড়ছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তার ক্ষমতায় যাওয়ার আভাসও রয়েছে বিভিন্ন জরিপে।

Scroll to Top