এমন নির্বাচন সচরাচর দেখা যায় না, বিশেষত প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে, যেখানে ভোটের আগেই ক্ষমতাসীন দল পরাজয় মেনে নেয়। যুক্তরাজ্যের কনিষ্ঠতম এবং প্রথম একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যখন ডাউনিং স্ট্রিটে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন, সে সময় আকস্মিক বৃষ্টি তাঁকে যেভাবে ভিজিয়ে দিয়েছিল, তাতে তখনই কথা উঠেছিল আলামত ভালো নয়, তাঁর এবার ভরাডুবি হবে। ভোটের আগের দিন গতকাল বুধবার ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলো দেখলে তাঁর এবং তাঁর দলের জন্য অনেকের করুণা বোধ হতে পারে।
বিরোধী দল লেবার পার্টির ভূমিধস বিজয়ের সম্ভাবনা এতটাই প্রবল যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোয়েলা বেভারম্যান কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় গতকাল নিবন্ধ লিখে হার মেনে নিয়ে দলকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে বাঁচানোর কথা বলেছেন। ভোটের ৩৬ ঘণ্টা আগে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের কাছে এখনো জনপ্রিয় বরিস জনসন নির্বাচনী সভায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে বলেছেন, লেবারের বিরাট বিজয় হবে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের মতো ভীতিকর। কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক আরেকটি পত্রিকা ডেইলি মেইল শিরোনাম করেছে, স্টারমার–বিভীষিকা ঠেকাতে বরিস ও ঋষি এক হয়েছেন (পত্রিকাটি শিরোনামে স্টরমাগেডন বিশেষণ ব্যবহার করেছে, যা স্টারমারের আর্মাগেডনের যৌগ এবং বাংলায় আর্মাগেডনের কোনো জুৎসই প্রতিশব্দ নেই)।
সংবাদপত্রের পাতায় নির্বাচনের গতিবিধির প্রতিফলন সম্পর্কে এরপর বিবিসির প্রশ্নের জবাবে পেনশনমন্ত্রী মেল স্ট্রাইড বলেন, লেবার পার্টি সম্ভবত এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, যা এর আগে কখনো কোনো দল পায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। সকালে ফেসবুকে ঢুকতেই কনজারভেটিভ পার্টির যে বিজ্ঞাপন আমার মোবাইলের পর্দায় উঠে এসেছে, তাতে আকুল আবেদন হচ্ছে লেবার পার্টির সুপার মেজরিটির অর্থ হবে তাদের কোনো জবাবদিহি থাকবে না। তাই আমার এলাকার স্বার্থ রক্ষায় আমি যেন কনজারভেটিভদের ভোট দিই। কনজারভেটিভদের এসব প্রচারণা তাদের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে হাজির করার শেষ চেষ্টা বলেও অনেকের ধারণা। লেবার পার্টির প্রধান কিয়ার স্টারমারও বলেছেন, সুপার মেজরিটির কথা বলার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে লেবার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা।
লেবার পার্টি পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে এই নির্বাচনে প্রচার চালাচ্ছে। তারা কনজারভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসনে যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, তা ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লেবার পার্টির বর্তমান নেতা কিয়ার স্টারমারের অধীন দলটিও অনেক বদলে গেছে। এই পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটেছে কিয়ার স্টারমার তাঁর পূর্বসূরি জেরেমি করবিন এবং তাঁর সমর্থক বামপন্থীদের মনোনয়ন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁদের দল ছেড়ে যেতে বাধ্য করার ঘটনাগুলোয়। বেসরকারি খাতের ভূমিকা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তিনি যেসব নীতিগত পরিবর্তন এনেছেন, তাতে তাঁকে বামপন্থীরা লেবারের পোশাকে কনজারভেটিভ হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করেছেন।
যুক্তরাজ্যে এর আগেও কখনো কোনো দল একটানা তিন মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলেই সব জনমত জরিপের ইঙ্গিত। বস্তুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে প্রধান দুই দলের প্রতি জনসমর্থন যা ছিল, ভোটের আগের দিনেও তা একই জায়গায় অনড় আছে। লেবার পার্টির পক্ষে ৪০ শতাংশ, আর কনজারভেটিভদের পক্ষে ২০ শতাংশ। গত পার্লামেন্টে তৃতীয় প্রধান দল ছিল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি এবং চতুর্থ স্থানে ছিল লিবারেল ডেমোক্র্যাটস। এবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে, লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা আবারও তৃতীয় প্রধান দল হিসেবে তাদের অবস্থান ফিরে পাবে।
এবারের নির্বাচনে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রধান দুই দলের প্রতি সামগ্রিকভাবে আস্থা কমে যাওয়া। দুই দলেরই বিপুলসংখ্যক সদস্য ও সমর্থক দল ছেড়েছেন। কনজারভেটিভ পার্টির অনেকেই অবসর নিয়েছেন এবং অনেকেই নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন রিফর্ম পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। রিফর্মের প্রতি জনসমর্থন প্রায় ১৬ শতাংশ। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, প্রথমবারের মতো রিফর্ম পার্টি এবার পার্লামেন্টে আসন পেতে চলেছে।
ভূমিধস বিজয়ের প্রান্তে থাকা লেবার পার্টি থেকে নির্বাচনের দুদিন আগেও কাউন্সিলরদের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। সর্বসম্প্রতি লন্ডনের নিউহ্যাম কাউন্সিলের কাউন্সিলর আরিক চৌধুরী মঙ্গলবার লেবার পার্টি ছেড়ে গ্রিন পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। কিয়ার স্টারমারের আসনেও ৬ শতাংশের বেশি ভোটার বাংলাদেশি হওয়ায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্যতম বর্ণবাদবিরোধী সংগঠক ও লেখক অ্যান্ড্রু ফ্যানস্টেইনও তাঁর প্রচারে বিষয়টিকে ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছেন। জর্জ গ্যালাওয়ের ওয়ার্কার্স পার্টিও বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। ফলে লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা কিছুটা বিড়ম্বনার মুখে পড়েছেন এবং কয়েকটি আসনে তার প্রতিফলন ঘটতে পারে।