বিভিন্ন মামলায় বর্তমানে সাজা ভোগ করছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং পিটিআই-য়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সাবেক খ্যাতিমান ক্রিকেটার ইমরান খান। সম্প্রতি পাকিস্তানের আদিয়ালা জেল থেকে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা এবং মার্কিন টিভি এমএসএনবিসির প্রাক্তন সাংবাদিক মেহদি হাসানকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে বর্তমান পাকিস্তান সরকারের সমালোচনা করেন ইমরান। এই সরকারের বৈধতাকেও চ্যালেঞ্জ করেন তিনি। এছাড়া জেনারেল বাজওয়া ইমরানকে আমেরিকা-বিরোধি বলে প্রচার করেছেন, নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ করে তুলেছেন, এমন অভিযোগ করেন ইমরান। “আল্লাহ জানেন অন্যান্য দেশে আর কী কী মিথ্যা প্রচার করেছেন তিনি,” ইমরান খান বলেন।
আটক অবস্থায় ইমরান খানের সাক্ষাৎকার নেওয়া সহজ ছিল না বলে নিজের ওয়েবসাইটে লিখেছেন মেহদি হাসান। সরাসরি কথা বলা সম্ভব নয় বলে তিনি ইমরান খানকে লিখিত প্রশ্নের একটি তালিকা পাঠান। এসব প্রশ্নের উত্তর পাঠানোর পর সেসব প্রশ্নের ফলোআপ করাও সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও সাক্ষাৎকারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেছেন মেহদি হাসান। এখানে সাক্ষাৎকারটির বাছাই করা একটি অংশ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো। পুরো সাক্ষাৎকার পড়ুন এখানে।
মেহদি হাসান: জেলে আপনার জীবন কেমন কাটছে? আপনার সাথে কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করা হয়েছে? অত্যাচার করা হয়েছে? ইমরান খান: আমাকে এমন একটি সেলে রাখা হয়েছে যাকে বলা হয় ডেথ সেল (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য নির্জন খুপড়ি)। খুবই ছোট একটা জায়গা যেখানে সাধারণত সন্ত্রাসীদের রাখা হয়। কর্তৃপক্ষ আমাকে সন্ত্রাসীর আদলেই দেখাতে চায়। একজন বন্দির যেসব মৌলিক অধিকার থাকার কথা, তার কিছুই আমাকে দেওয়া হয় না। তারা এসব করে আমার মনোবল ভাঙ্গার চেষ্টা করছে।
কিন্তু আল্লাহর ওপর বিশ্বাস থাকায় আমার মন এখনো শক্ত আছে। আমি ব্যায়াম এবং পড়াশোনা করে নিজেকে ব্যস্ত রাখছি, আমার মস্তিষ্ক ধারালো রাখছি। ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখছি। আল্লাহর দয়ায় আমি এখনো টিকে আছি, নিজের পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট আছি, এবং নিজের লক্ষ্যে স্থির আছি।
মেহদি হাসান: বর্তমানে নিজের বন্দিদশার জন্য আপনি কাকে দায়ী করেন? পাকিস্তানে আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে, যুক্তরাষ্ট্রকে? না কি এদের সবাইকে? ইমরান খান: গত দুই বছরে আমি আমার সবগুলো পদক্ষেপ এবং সেগুলোর পরিণতি বিাচর-বিশ্লেষণ করার প্রচুর সময় পেয়েছি। ১১ মাস জেলে কাটানোর পর এখন আমি প্রায় নিশ্চিত যে এ সবের পেছনে একমাত্র জেনারেল বাজওয়ার হাত ছিল।
আমি অন্য কাউকে দোষ দিই না। তিনি সুক্ষ্মভাবে এই পুরো ব্যাপারটা পরিকল্পনা করেছেন, বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। মিথ্যা এবং বানোয়াট বয়ান তৈরি করে, কূটকৌশলের মাধ্যমে তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দুই ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা তৈরি করে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগিয়েছেন। এর ফলে যে গণতন্ত্র এবং পাকিস্তানের ওপর কতটা খারাপ প্রভাব পড়েছে, তা তিনি বুঝতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
মেহদি হাসান: বিশ্ববাসীর জন্য আপনার বার্তা কী? আপনার সাথে যা হচ্ছে, তা পাকিস্তানের বাইরের লোকদের জানা কেন দরকার? ইমরান খান: আমার বার্তা খুবই সহজ-সরল। ঘটনাটি শুধু ইমরান খানের সাথে করা হয়নি। বরং তা গণতন্ত্র এবং ২৫ কোটি পাকিস্তানি জনগণের ওপর আঘাত হিসেবে এসেছে। নারী, পুরুষ, শিশুরা নিহত হয়েছে, তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, অত্যাচার করা হয়েছে। কেউ টু শব্দ করেনি।
মাত্র একটি রাজনৈতিক দলকে সবদিকে দিয়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি, আমার তথ্যসচিবের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তানে মাসের পর মাস ‘এক্স’ এর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে রাখা হয়েছে। টিভিতে আমার নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। আমার দলের নেতাদের টিভিতে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশের সব দল জানে, পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য নির্বাচন হয়েছে এবার। নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবার কথা, কিন্তু এই নির্বাচনে তা হয়নি। বরং ক্ষমতাসীন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি আরও প্রকট হয়েছে।
আমার সাথে যা হচ্ছে, এ নিয়ে কেউ কথা বলছে না, আমার তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের গণতন্ত্র এবং ২৫০ মিলিয়ন মানুষের নির্বাচনী অধিকার দিনেদুপুরে হরণ করা হয়েছে, এ নিয়ে বিশ্বের সোচ্চার হওয়া উচিত।
মেহদি হাসান: সমর্থকেরা আপনাকে অনেকটা আলৌকিক দৃষ্টিতে দেখে থাকে। আপনি কি মনে করেন, আপনার মধ্যে আসলেই বিশেষ কিছু আছে? আপনার এই যাত্রার পেছনে কি ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক কোনো কারণ আছে?
ইমরান খান: একজন পাকিস্তানি এবং একজন মুসলিম হিসেবে আমি নিজের কর্তব্যটুকু পালন করছি। আমি যে সব পদক্ষেপ নিয়েছি, এসব পদক্ষেপ নিয়ে কোনো অনুশোচনা বোধ করি না।
আল্লাহ আমাকে সব দিয়েছেন। অর্থ থেকে শুরু করে জনপ্রিয়তা পর্যন্ত। এসব শুধুমাত্র নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করাটা অনুচিত। আমি জনপ্রিয় এবং মানুষ আমাকে অনুসরণ করে। এর কারণ হলো তারা জানে যে আমি তাদের সাথে মিথ্যাচার করব না। তারা জানে আমাকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না, বদলানো যায় না। তারা জানে আমি কখনো মাথা নিচু করব না, তাদেরকে নিরাশ করব না। আমি তাদেরকে দেখিয়েছি, নীতি মেনে চললে তাদের জীবন বদলে যেতে পারে। আমি আমাদের দেশের সম্ভাবনা তুলে ধরেছি, এটাও দেখিয়েছি যে, অন্য দলগুলো কীভাবে নিজের স্বার্থে ফায়দা লুটেছে। আমার সাথে জনগণের বন্ধন জোরদার এবং আমরা একসাথেই সফল হব।
মেহদি হাসান: আপনি কি পাকিস্তানের বর্তমান সরকারকে বৈধ মনে করেন, নাকি বিশ্বাস করেন আপনার দলই আসলে নির্বাচনে জিতেছিল এবং আপনারাই পাকিস্তানের আসল সরকার হওয়ার দাবিদার? ইমরান খান: বর্তমান সরকারের বৈধতার অভাব আছে। পিএমএল-এন কোনোমতে ১৭টি আসনে জয়লাভ করেছিল। নির্বাচনে তাদের সন্ত্রাস, অত্যাচার এবং জালিয়াতি একদম স্পষ্ট। নির্বাচনের পরেও প্রায় দুই দিন সময় নিয়ে তারা ফলাফল জালিয়াতি করে।
আমি আপনাকে অনুরোধ করি, মেহদি। ফর্ম-৪৫ খুঁটিয়ে দেখুন। সহজেই কারচুপি দেখতে পাবেন। ওরা এই কারচুপি ঠিকমতো ঢাকতেও পারেনি। এটা শুধু আমার কথা না, যে কোনো পাকিস্তানিকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি বলবেন এই সরকার অবৈধ। প্রতিপক্ষ যতই চেষ্টা করুক না কেন আমার দলের বিজয় সুনিশ্চিত ছিল।
মেহদি হাসান: আপনার পাশে কোনো মিত্র দাঁড়ায়নি। আপনি যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, এবং চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনীর বিপক্ষেও চলে গিয়েছিলেন। সে সময়ে আপনার ভাবনা কেমন ছিল?
ইমরান খান: আমি সবসময় পাকিস্তানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে গেছি। ন্যায়বিচারে সমতা থাকলে আমার মত একজন মানুষের রাজনীতিতে আসার কোনো প্রয়োজনই পড়ত না। আমি বেশিরভাগ দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলাম। জেনারেল বাজওয়ার কুটকৌশল কিছু সময়ের জন্য হয়ত প্রভাব রেখেছে, কিন্তু তা বেশিদিন থাকবে না।
আমার সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠানোর পরেও আমি বেশিরভাগ দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখেছি। অস্থিতিশীল একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক দেশই আমাদের সেনাবাহিনীকে নির্ভরযোগ্য ক্ষমতাকাঠামো বলে মনে করে। কিন্তু এই নির্ভরযোগ্য বাহিনী যখন কূটকৌশল এবং অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করে, এমন পরিস্থিতিতে অন্য দেশের পক্ষে তাদের মতামত প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
আমার সাথে যা হচ্ছে, এ নিয়ে কেউ কথা বলছে না, আমার তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু পাকিস্তানের গণতন্ত্র এবং ২৫০ মিলিয়ন মানুষের নির্বাচনী অধিকার দিনেদুপুরে হরণ করা হয়েছে, এ নিয়ে বিশ্বের সোচ্চার হওয়া উচিত।