গোলা-বারুদের ঘাটতির ফলে ৬২০-মাইল দীর্ঘ রণাঙ্গনে ইউক্রেনের অবস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। পুরো রণাঙ্গন এখন রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর মারাত্মক আক্রমণের মুখে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যূহ হুমকির মুখে পড়েছে।
গত চার মাস ধরে প্রতিদিন তিন দিক থেকে রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউক্রেনীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে দনেৎস্ক এলাকার আভডিভকা শহর থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।
রুশ সীমান্ত থেকে দূরে, ইউক্রেনের বেশ অভ্যন্তরে আভডিভকায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যাপক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিল। রাশিয়া ২০১৪ সালে যখন প্রথম আক্রমণ চালায়, তখন থেকে আভডিভকা একটি রণাঙ্গন। আভডিভকার সুরক্ষিত সুরঙ্গ আর ট্রেঞ্চ নেটওয়ার্ক আরো পশ্চিমে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথগুলোকে নিরাপত্তা দেয়।
আভডিভকা দখলের ফলে রাশিয়ার মনোবল চাঙ্গা হবে, এবং এই যুদ্ধে তাদের সৈন্যরা চালকের আসনে আছে বলে ক্রেমলিনের দাবিকে সমর্থন করবে। অন্যদিকে, শহরের পতন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য হতাশা নিয়ে আসবে, যারা গত বছরের পাল্টা অভিযানের পর শুধুমাত্র কিছু এলাকা উদ্ধার করেছে।
বাইডেন প্রশাসন আভডিভকার পতনের জন্য ইউক্রেনের জন্য ৬০০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য অনুমোদন করতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানিয়েছেন যে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোডিমির জেলেনস্কিকে শনিবার টেলিফোনে আলাপের সময় বলেছন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অবশেষে চলে আসবে। ইউক্রেন আভডিভকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর বাইডেন জেলেনস্কির সাথে কথা বলেন।
তবে, সংবাদদাতারা যখন জিজ্ঞেস করেন, ইউক্রেন আরো এলাকা হারানোর আগেই কংগ্রেসে সমঝোতা হবে বলে তিনি আত্মবিশ্বাসী কি না, বাইডেন উত্তর দেন, ‘না।’
দূর-পাল্লার অস্ত্রের অভাব
আভডিভকার পতনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে রণাঙ্গনের সবচেয়ে সক্রিয় অংশে এসোসিয়েটেড প্রেস গোলন্দাজ ইউনিটের প্রধানসহ এক ডজনের বেশি ইউক্রেনীয় কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা বলছেন, অস্ত্র-সরঞ্জামের ঘাটতি, যা রাশিয়া পুরোদমে আক্রমণ চালানোর পর থেকেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য সমস্যা ছিল, তা গত শরতকাল থেকে আরো তীব্র হয়েছে।
পশ্চিমাদের দেয়া দূর-পাল্লার আরটিলারির সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এর মানে হচ্ছে, ইউক্রেনীয় বাহিনীর পক্ষে রুশ বাহিনীর গভীরে, যেখানে তাদের ভারী সরঞ্জাম আর সৈন্য সমবেত করা হয়, সেখানে আক্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কয়েক সপ্তাহ ধরে রণাঙ্গন জুড়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা গোলা-বারুদের মারাত্মক অভাবের অভিযোগ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরটিলারি ইউনিট তাদের প্রয়োজনের মাত্র ১০ শতাংশ সরবরাহ নিয়ে লড়াই করছে। শেল বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে তারা তাদের ইউনিটগুলোকে শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার নির্দেশ দেয়।
তবে রণাঙ্গনে কমান্ডাররা বলেন, এই নীতি দিয়ে তাদের শত্রুপক্ষকে থামিয়ে দেয়া সম্ভব না। কারণ রুশদের অনেক বেশি গোলা-বারুদ সরবরাহ আছে। নতুন সামরিক সাহায্য ছাড়া আভডিভকার পতনের পুনরাবৃত্তি অন্য জায়গায় দেখা যাবে বলে উদ্বেগ এখন বাড়ছে।
মস্কোর জন্য বিজয়
অত্যন্ত সুরক্ষিত শহর থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রত্যাহার করা গত বছরের বাখমুতের জন্য লড়াইয়ের পর রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বিজয় নিয়ে এসেছে। এর ফলে, ক্রেমলিনের বাহিনী আরো পশ্চিমে অগ্রসর হতে পারবে, কম সুরক্ষিত ইউক্রেনীয় এলাকার আরো গভীরে। সামরিক ব্লগারদের মতে, আরো পূর্বে রেলওয়ে জাঙ্কশন পক্রভস্ক রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে।
রাশিয়ার সামরিক কর্মকর্তা এবং ব্লগাররা বলছে, আভডিভকা দখলের ফলে রুশ-দখলকৃত ডনেতস্ক শহরের উপর হুমকি কমিয়ে দিয়েছে।
কামানের শেল বাঁচানো
‘এই মুহূর্তে গোলাবারুদের ঘাটতি বেশ সিরিয়াস। আমাদের সব সময় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে আরও আসছে, কিন্তু আমরা সেটা আসতে দেখি না,’ বললেন খরব্রাই, একটি আরটিলারি ইউনিটের কমান্ডার। তিনি বলেন, তার ইউনিটের প্রয়োজনের মাত্র ৫-১০ শতাংশ গোলা-বারুদ তাদের আছে।
এই অবস্থায় তিনি বলেন, তার বাহিনীর কার্যকরভাবে আক্রমণ করে হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আরো মারাত্মক, পদাতিক সৈন্যদের জন্য আরটিলারি সাপোর্ট না থাকায় আরো বেশি সৈন্য হতাহত হচ্ছে।
এই রিপোর্টের জন্য যেসব অফিসারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাদের সবার মতো তিনিও নিরাপত্তার স্বার্থে শুধুমাত্র তার প্রথম নাম ব্যবহার করার শর্তে কথা বলেছেন।
‘যুদ্ধ করার মত অস্ত্র আমাদের নেই,’ বললেন ভ্যালেরি, যিনি একটি হাউইটযার ইউনিটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা ন্যাটো-ব্যবহৃত ১৫৫ মিলিমিটার শেল ব্যবহার করে। কোন রুশ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাদের প্রতি ইউনিটের প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০টি শেল দরকার। আজ তাদের প্রয়োজনের ১০ শতাংশ রয়েছে, তিনি বলেন।
রাশিয়ার কৌশল পরিবর্তন
আভডিভকায় মোতায়েন ইউক্রেনীয় সৈন্যরা বলছে, শহরের পতনের আগে রাশিয়া গোলা-বারুদের ঘাটতি কাজে লাগাতে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। সাঁজোয়া গাড়ির কলাম দিয়ে আক্রমণ না করে তারা পদাতিক সৈন্যর ছোট ছোট গ্রুপ পাঠিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর সাথে আরো কাছ থেকে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এর ফলে, তাদেরকে আটকে রাখতে ইউক্রেন বাহিনীকে পাঁচ গুন বেশি গোলা-বারুদ ব্যবহার করতে হয়েছে।
‘শত্রু বাহিনী আমাদের সক্ষমতা বুঝতে পারে এবং সেটা দিয়ে তারা সফল হতে পেরেছে,’ বললেন চাকলুন, ১১০ ব্রিগেডের একজন সৈন্য।
নড়বড়ে উত্তরাঞ্চল
রণাঙ্গনের অন্যান্য সেক্টরে এই গোলাবারুদের ঘাটতি কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুপিয়ান্সক লাইন বেশ দুর্বল। গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়া এই এলাকা লক্ষ্য করে তাদের আক্রমণ জোরদার করছে। তারা চেষ্টা করছে এই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কেন্দ্র আবার দখল করতে, যেটা তারা ২০২২ সালের শরত কালে হারিয়েছিল।
কুপিয়ান্সক-এ ৪৪ ব্রিগেডের কমান্ডার ইউরি বলছেন, তার গোয়েন্দা বিমান ইউনিটগুলো অনেক দূর-পাল্লার লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে, যাদের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার মর্টার আর গ্রেনেড নিক্ষেপের কামান। কিন্তু যথেষ্ট গোলা-বারুদ তাদের নেই, তাই তারা সেই লক্ষ্যগুলোতে আঘাত হানতে পারছে না। সেটা না করে, তার শত্রু কিভাবে সৈন্য সমবেত করছে, সেটা দূর থেকে দেখা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।
অলেক্সান্দের বলেন, এই মুহূর্তে তার যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ আছে। তিনি কুপিয়ান্সক-এ ৩২ ব্রিগেডের একটি ব্যাটালিওনের কমান্ডার।
‘কিন্তু সব নির্ভর করছে রাশিয়ার দিক থেকে তীব্রতার উপর। তারা যদি মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে এই লাইন ধরে রাখা সম্ভব হবে না,’ তিনি বলেন।