ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন লৌহমানবখ্যাত সাবেক জেনারেল প্রাবোও সুবিয়ান্তো। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও বেশ পুরোনো। তাঁকে ২০১৯ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে বসান বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। টানা দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে থাকায় এবার বিদায় নেবেন উইদোদো। কিন্তু তিনি নিজের অনুগত প্রতিরক্ষামন্ত্রী সুবিয়ান্তোকে সমর্থন দিয়ে সমালোচিত হন।
বুধবারের এ নির্বাচনে সুবিয়ান্তোর রানিং মেট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হচ্ছেন উইদোদোর বড় ছেলে জিবরান রাকাবুমিং রাকা। প্রথম রাউন্ডেই জয়ী হচ্ছেন সুবিয়ান্তো। খবর বিবিসির।
বেসরকারিভাবে প্রকাশিত ফলে এগিয়ে আছেন সুবিয়ান্তো। তিনি পেয়েছেন ৫৮ শতাংশের বেশি ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাকার্তার সাবেক গভর্নর আনিস বাসওয়েডান পেয়েছেন ২৪ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, ভোটে নানা অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন আনিস।
ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচনকে বলা হয় এক দিনে আয়োজিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে প্রায় ১৭ হাজার দ্বীপে ২০ হাজার ৬০০ পদের বিপরীতে প্রায় ২ লাখ ৫৯ হাজার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ভোটার সংখ্যা ২০ কোটির বেশি।
দেশটির নির্বাচনী আইন অনুসারে, যদি কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মোট ভোটের ৫০ ভাগের বেশি এবং সেইসঙ্গে দেশের ৩৮টি প্রদেশের ২০টিতে কমপক্ষে ২০ ভাগ ভোট না পান– তাহলে নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় রাউন্ডে।
ভোট অনুষ্ঠিত হলেও অনেক ইন্দোনেশিয়ান এখন উদ্বিগ্ন। সুবিয়ান্তো ক্ষমতায় এলে দেশটির গণতন্ত্রের আসলে কী হবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে থাকা সাবেক সামরিক কর্মকর্তা সুহার্তোর ৩২ বছরের একনায়কতন্ত্রের পতনের ঠিক আগ মুহূর্তে ১৯৯৮ সালে দেশটিতে বড় ধরনের দাঙ্গা হয়। এতে মারা যায় ১ হাজারের বেশি মানুষ। সেই সময় মূলত সুহার্তো সরকারের দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সমস্যা, খাদ্য সংকট এবং ব্যাপক বেকারত্বের কারণে ফুঁসে উঠেছিল ত্যক্তবিরক্ত মানুষ। কিন্তু এই বিক্ষোভ দমনে তখন বড় ভূমিকা রাখেন সুবিয়ান্তো। তিনি তখন সেনা কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের।
সে ঘটনায় ছেলে উকোককে হারান পাইয়ান সিয়াহান নামের এক নারী। ৭৮ বছর বয়সী এ বিধবা বলেন, ‘আমি সুবিয়ান্তোকে জিজ্ঞেস করতে চাই, আমার ছেলে কোথায়? যদি সে মারা যায়, আমাকে বলুন– তার লাশ কোথায় আছে। যদি সে এখনও বেঁচে থাকে, তাহলে সে কোথায়?’
প্রাবোও সেই সময় যে সেনা ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন, সেই ইউনিটের বিরুদ্ধে ২৩ জনকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে একজন মারা যায়। আর ১৩ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুবিয়ান্তোর বিরুদ্ধে এটিই একমাত্র অভিযোগ নয়। তিনি উচ্চাভিলাষী, কৌশলী এবং চড়া মেজাজের কর্মকর্তা, যিনি স্বৈরশাসক সুহার্তোর জামাতা হিসেবে বাড়তি সুবিধায় সামরিক বাহিনীতে দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার তিমুর লেস্তে দখলের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে তিমোরিজ নেতা নিকোলাও লোবাটোকে হত্যাকারী সামরিক ইউনিটে ছিলেন তিনি।
অনেকেই বিশ্বাস করেন, সুবিয়ান্তো ১৯৯৮ সালের মে মাসে জাকার্তা এবং অন্যান্য শহরে দাঙ্গার জন্য দায়ী। তিনি অবশ্য এতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
১৯৯৮ সালে দাঙ্গার পর সুহার্তো পদত্যাগ করলে অপহরণের দায়ে সুবিয়ান্তোকে বরখাস্ত করে সেনাবাহিনী। এরপর নির্বাসনে এক বছরেরও বেশি সময় ছিলেন জর্ডানে। পরে তাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানান জোকো উইদোদো।
জোকো সরকার দেশের উন্নতি-অগ্রগতি করলেও তাঁর বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। তিনি এক সময়ের স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনকে কাজ করতে বাধা দেন। তাঁর সমালোচনাকারীদের দমন করতে সাইবার-অপরাধ আইন পাস করেন।
দেশটির ঔপন্যাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ওকি মাদাসারি বলেছেন, ‘জোকো রাজনীতিবিদ, কিন্তু ভালো নেতা নন। এ ধরনের ব্যক্তি ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।’ এক তরুণ ভোটার বলেন, তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত, এই ভেবে যে প্রাবোও জয়ী হবেন। কারণ, তিনি নির্বাচিত হলে সবার মুখ বন্ধ করে দেবেন।