ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে যুদ্ধাবসান এবং সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।গত শুক্রবার এক সাক্ষাৎকারে এই আহ্বান জানিয়েছেন ৮৭ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্ট।
পশ্চিম তীরের রামাল্লাহ শহরে নিজ কার্যালয়ে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘আমি সবসময়ই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পক্ষে। আমার প্রস্তাব— একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আহ্বান করে বৈশ্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের সমন্বয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক।’
\’তবে সবার আগে প্রয়োজন গাজায় যুদ্ধপরিস্থিতির অবসান ঘটানো। কারণ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় গত দু’মাসে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত খুবই বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেচে এবং গাজার যুদ্ধের আঁচ ব্যাপকভাবে টের পাচ্ছেন পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরাও। পশ্চিম তীরের শহরে শহরে ইহুদি বসতকারীদের সঙ্গে সংঘাত বাড়ছে ফিলিস্তিনিদের।\’
তিনি আরও বলেন, \’আমি মনে করি, একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন কেবল গাজার যুদ্ধাবসান কিংবা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয়, বরং ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাব দূর করতেও সহায়ক হবে।\’
প্রসঙ্গত, স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো ১৯৬৪ সালে পিএলও বা পিএ জোট গঠন করে। শুরুর দিকে ইসরায়েলের বিলুপ্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে গেলেও পরে ১৯৮৩ সালে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় পিএলও।
এই স্বীকৃতি দানের কয়েক বছর পর ১৯৮৩ সালে গঠিত হয় সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী হামাস। এই গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিলুপ্তি ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
২০০৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে গাজা উপত্যকা দখল করে হামাস। তারপর থেকে এখনও ক্ষমতাসীন রয়েছে এই গোষ্ঠীটি। হামাসের শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই থাকেন কাতারে, আর মধ্যম সারির নেতারা লেবাননে অবস্থান করছেন।
রয়টার্সকে মাহমুদ আব্বাস জানান, পিএ পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর এবং গাজায় গত ২০২১ সালে নির্বাচনের আয়োজন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি। আমরা ২০২১ সালের এপ্রিলে ওই নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম। ভোটের তারিখও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত আমাদের বললেন, ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমে ভোটকেন্দ্র স্থাপনে আপত্তি জানিয়েছেন এবং তারা চায় আমরা যেন আপাতত এই নির্বাচন স্থগিত করি। আমরা সে সময় নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিলাম।\’
১৯৬৭ সালের আরব ইসরায়েল যুদ্ধে প্রথম পূর্ব জেরুজালেম দখল করে ইসরায়েল। পরে ধীরে ধীরে একসময় পুরো জেরুজালেম দখল করে শহরটিকে নিজেদের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
নভেম্বরের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছিলেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের পর গাজা শাসনক্ষমতা পশ্চিম তীরে ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যাস্ত করা হবে। তবে ব্লিনকেনের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, গাজা উপত্যকা শাসনের ক্ষমতা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেই এবং চলমান যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও গাজায় অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় ইসরায়েল।
নেতানিয়াহু এই বক্তব্য দেওয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শুক্রবারের সাক্ষাৎকারে মাহমুদ আব্বাস বলেন, \’যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জানিয়েছে যে তারা দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে এবং গাজায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব তারা চায় না। কিন্তু ইসরায়েলকে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো চাপ তারা দেয়নি।\’
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট বলেন, \’গাজায় ২০০৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত ও পরে হামাসের বৈরীতার শিকার হয়েছে পিএ। কিন্তু উপত্যকার সরকারি প্রশাসনিক ও পরিষেবা কর্মকর্তা-কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খাতে ব্যয়ের জন্য এখনও প্রতি মাসে ১৪ কোটি ডলার গাজায় পাঠাচ্ছে পিএ। এমনকি গাজার মন্ত্রিসভায় পিএর তিনজন সদস্যও রয়েছেন।\’
\’গাজা আর এখন আগের মতো নেই। সেখানাকার স্কুল, হাসপাতাল, অবকাঠামো, ভবন, পথঘাট, মসজিদ— সব ধ্বংস হয়ে গেছে। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এই যুদ্ধ শেষে গাজাকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং সে সময় আমাদের বিপুল পরিমাণ সহায়তার প্রয়োজন হবে।\’