জাতিগত সংঘাতে অস্থির ভারতের মণিপুর, দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ

জাতিগত সংঘাতে ভারতের মণিপুর রাজ্য অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। রাজ্যটিতে কয়েক দিন ধরেই পুলিশ এবং আদিবাসীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। বহু এলাকায় হাতাহাতি, মারধর, দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট এমনকি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাও ঘটেছে। সহিংস এলাকাগুলোয় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট সেবা।

গেল ৪৮ ঘণ্টার সংঘাতে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম অন্তত ১৬ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। আহত শতাধিক মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজনা নিরসনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বুধবার অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আদিবাসী ঐক্য মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল মণিপুরের চূড়াচাঁদপুর জেলায়। সেই মিছিলকে কেন্দ্র করে নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা।

মণিপুরে রাজনৈতিক বা জাতিগত উত্তেজনা নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা ছড়িয়েছে কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে। প্রায় এক দশক ধরে নানাভাবে মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইরা আইনিভাবে তপশিলি উপজাতি বা ‘শিডিউলড ট্রাইব’হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের বক্তব্য, স্বাধীনতার আগে স্বাধীন মণিপুর রাজ্যে তাদের ‘উপজাতি’হিসেবেই স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাদের এই তকমা কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে জমি থেকে ঐতিহ্য, ভাষা, পোশাক সবকিছুতেই স্বকীয়তা বজায় রাখার যে সুবিধাগুলো তপশিলি উপজাতিরা পেয়ে থাকেন, তারা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই মর্মে তারা আবেদন করেন মণিপুর হাইকোর্টে।

সব আবেদন শুনে রাজ্য সরকারকে চার সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারীদের দাবি-দাওয়া যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে রাজ্যের অবস্থান জানাতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এতে চটে যায় মণিপুরের বাকি উপজাতিরা। তাদের বক্তব্য, এতে অন্যায়ভাবে সুবিধে পেয়ে যাবেন মেইতেইরা এবং তাতে ক্ষতি হবে নাগা, কুকিসহ বাকি উপজাতি গোষ্ঠীগুলো।

তাদের অভিযোগ, এমনিতেই মেইতেইরা যথেষ্ট অগ্রসর। রাজ্যের বেশিরভাগ বসতি যেহেতু উপত্যকায়, বিধানসভার আসনও বেশিরভাগ ওখানেই। মেইতেইরাও বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেইতেই ভাষাকে সংবিধানের বাইশটি সরকারি ভাষার একটির মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া মেইতেইরা বেশিরভাগ হিন্দু হওয়ায় এমনিতেই তপশিলি জাতি বা অনগ্রসর জাতি হিসেবে সুযোগ সুবিধা পান। তারা তপশিলি উপজাতি-ভুক্ত হলে বাকি উপজাতিদের কাজের ক্ষেত্রে বা পড়াশোনায় বা চাকরি-বাকরিতে যেটুকু যা সুযোগ-সুবিধা ছিল, তাও থাকবে না। এমন যুক্তি দেখিয়ে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। এর পরই শুরু হয় সহিংস পরিস্থিতি। যা দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বের অন্যতম বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি রাজ্য মণিপুর। এখানে প্রায় ৩৪টি ছোট বড় নানা জনগোষ্ঠীর বাসভূমি। মেইতেইরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩%। তাদের অধিকাংশই এই উপত্যকা অঞ্চলে থাকেন। বাকি রাজ্যের ৯০% পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাকি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীদের ‘নাগা’অথবা ‘কুকি’— এই দুই ‘চিহ্নিত উপজাতি’-তে বিভক্ত করা হয়েছে।