সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের জন্য বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী ৫ দেশের প্রশংসা করেছেন মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। গতকাল বুধবার দেশটির ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন।
মিয়ানমারের সরকারি টেলিভিশন এমআরটিভি বুধবার মিন অং হ্লেইংয়ের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করেছে। ভাষণে জান্তাপ্রধান বলেন, ‘আজ দেশের স্বাধীনতা দিবসে আমি মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মিত্রদের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই। নানামুখী চাপ, সমালোচনা, হামলা সত্ত্বেও তারা আমাদের পাশে আছেন, সহযোগিতা করছেন— সেজন্য তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।’
‘আমাদের প্রতিবেশী দেশ চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি এবং আমরা আশা করছি সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক উন্নয়নের স্বার্থে ভবিষ্যতেও আমাদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অক্ষুন্ন থাকবে।’
এছাড়া স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এদিন মিয়ানমারের বিভিন্ন কারাগার থেকে ৭ হাজার ১২ জন কয়েদিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন জান্তাপ্রধান। এ প্রসঙ্গে ভাষণে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সাধারণ জনগণকে ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। বিগত বিভিন্ন বছরের মতো এ বছরও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাধারণ ক্ষমার আওতায় কিছু সংখ্যক কারাবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ বছরের স্বাধীনতা দিবসে ৭ হাজার ১২ জন কয়েদিকে মুক্তি দিয়েছে সরকার।’
তবে পৃথক এক প্রতিবেদনে এমআরটিভি জানিয়েছে, যেসব কয়েদির বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, বিস্ফোরক মামলা, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক এবং দুর্নীতির মামলা আছে— তাদেরকে এই মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় রাখা হয়নি।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের কয়েকটি পুলিশ স্টেশন ও সেনাছাউনিতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পর সেখানকার সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা এবং নারী ও শিশুদের ধর্ষণের পাশাপাশি লুটপাট ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
এ অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন জেনারেল মিন অং হ্লেইং। সে সময় মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ছিলেন তিনি। পরে জাতিসংঘের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করে দিতেই এ অভিযানের পরিচালিত হয়েছিল।
সেনাবাহিনীর নির্যাতনে টিকতে না পেরে ২০১৭ সালে আরাকান থেকে পালিয়ে আসে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করেনি মিয়ানমার।
আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যখন অভিযান চলছিল, সেসময় মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন ছিল দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার। সেনা অভিযান বন্ধে ওই সরকারকেও কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
২০২০ সালে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ভূমিধস জয় পেয়ে ফের ক্ষমতায় আসে এনএলডি সরকার। কিন্তু ওই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে—অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। এই অভ্যুত্থানেও নেতৃত্ব দিয়েছেন জেনারেল মিন অং হ্লেইং।
ক্ষমতা দখলের পর সুচিকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া মিন অং হ্লেইং হন নতুন সামরিক সরকারের প্রধান।
সুচির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলাও দিয়েছে সামরিক সরকার। রাজধানী নেইপিদোর এক সামরিক আদালতে চলছে সেসব মামলার বিচার।
এদিকে, অভ্যুত্থানের পরের দিন থেকেই বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী জনতা। রাজধানী নেইপিদোসহ ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে শুরু হয় জান্তাবিরোধী আন্দোলন।
আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে দৃশ্যত সংযমের পরিচয় দিলেও পরে তা দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয় জান্তা সরকার। গত দুই বছরে মিয়ানমারে নিহত হয়েছেন আড়াই হাজারেও বেশি মানুষ।
গত ৩০ ডিসেম্বর নেইপিদোর সামরিক আদালতে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে অং সান সুচিকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে জান্তা মুখপাত্রদের দাবি, স্বাধীন আদালতের সব রকম নিয়মনীতি মেনেই সুচির মামলাগুলোর বিচারকাজ চলছে।
সংবাদ সূত্রঃ এমআরটিভি