দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে অবৈধভাবে অস্ত্র রফতানির অভিযোগ উঠেছে। মিয়ানমার নৌবাহিনীর কাছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুটি কোম্পানি একটি যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করেছে। বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশ এখন তদন্তে নেমেছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘মিয়ানমার নাউ’র এক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশ করা হয়েছে।
আজ বুধবার (১৯ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে ‘মিয়ানমার নাউ’ জানায়, ২০১৯ সালে মিয়ানমার নৌবাহিনীর কাছে ইউএমএস মোতামা নামে একটি যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করে দক্ষিণ কোরিয়া। যুদ্ধজাহাজটি ওই বছরের ডিসেম্বরেই মিয়ানমার নৌবাহিনীর ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে উদ্বোধন করা হয়।
খবরে বলা হয়, যুদ্ধজাহাজটি বিক্রির ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার ফরেন ট্রেড অ্যাক্ট আইন লংঘন করা হয়েছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ ওঠার পর এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। পসকো ইন্টারন্যাশনাল ও দায়েসান শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামে দুটি কোম্পানির পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে পুলিশ।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্টিল কোম্পানি পসকোর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পসকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে এক চুক্তির ভিত্তিতে ইউএমএস মোতামা যুদ্ধজাহাজটি নির্মাণ করে দায়েসান শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। যুদ্ধজাহাজটি ক্রয়ের জন্য জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান দায়েসান শিপবিল্ডিংয়ের কাছে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবার একটি আবেদন পাঠায় মিয়ানমার। তবে সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এর মাত্র চার মাসের মাথায় আবারও আবেদন জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার মাত্র দুই মাস আগে ২০১৭ সালের জুন মাসে সরাসরি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন প্রোগ্রাম অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে একটি চিঠি পাঠান জন উইন নামে মিয়ানমার নৌবাহিনীর এক কমোডর। তাতে ‘দ্রুততার সঙ্গে’ একটি ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম ডক বা এলপিডি জাহাজ রফতানির অনুমতি চেয়ে আবেদন জানানো হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, জাহাজটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষিপণ্য পরিবহনের মতো বেসামরিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হবে। পসকো ইন্টারন্যাশনাল ও দায়েসান শিপবিল্ডিং সরকারের কাছে পরিকল্পনা জমা দিয়েছিল, তাতেও বলা হয় যে, জাহাজটি বেসামরিক কর্মকাণ্ডের জন্য নির্মাণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার নৌবাহিনীকে মূলত একটি সামরিক যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করা হয় এবং সেটা করা হয় দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের সঙ্গে মিয়ানমার নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের আলোচনার মাধ্যমে।
প্রতিবেদন মতে, চুক্তির কয়েক মাস পরই ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এরপরও মিয়ানমার নৌবাহিনীর কাছে সরবরাহ করা হয় যুদ্ধজাহাজটি। ২০১৯ সালে নৌবাহিনীর ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন যুদ্ধজাহাজটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। বর্তমানে যুদ্ধজাহাজটি রাখাইনে সেনা মোতায়েনে ব্যবহার হচ্ছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকেই দেশটিতে চলছে দমন-নিপীড়ন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার বহু সংবাদ দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সম্প্রতি দেশটিতে জনগণের ওপর চালানো নির্যাতন কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে সদস্যদেশগুলোকে মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।
সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মিদের দমাতে লড়াই করছে সরকার। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই রাজ্যের লড়াইয়ের প্রভাবে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে সেদেশেও। মিয়ানমারের ছোড়া গোলাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে বাংলাদেশ সীমান্তে। ক্রমেই সামরিক সামর্থ্য বাড়িয়ে চলেছে মিয়ানমার।
অং সান সু চি’র রাজনৈতিক দল এনএলডি নির্বাচনে বিজয়ের পর ক্ষমতায় তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর ঠিক আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। ওই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। ফলে মিয়ানমার এখন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটির সামরিক সামর্থ্য কমেনি বা তাদের সমরাস্ত্র কেনা থেমে নেই।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন প্রতিনিধিরা মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায়। সে সময় ওই মিশনের দেয়া রিপোর্টে মিয়ানমারের কাছে কোন্ কোন্ দেশ অস্ত্র বিক্রি করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত, চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ফিলিপিন্স, ইসরাইল ও ইউক্রেন-এই সাতটি দেশের কয়েকটি কোম্পানি মিয়ানমারকে অস্ত্র সরবারহ করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী দুই দেশ চীন ও ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতার কারণে দেশটির সমরাস্ত্রের বড় অংশটি তারা এই দুইটি দেশ থেকে কেনে। চীন ও ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে যখন প্রথম দফায় দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সান সু চি‘কে গৃহবন্দি করা হয়, সেসময় পশ্চিমা দেশগুলো তৎকালীন বার্মার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, ওই সময়ও চীন ও ভারত দেশটিকে সমর্থন যুগিয়েছে। ২০১৮ সালে মিয়ানমারকে একটি রুশনির্মিত সাবমেরিন উপহার দিয়েছে ভারত।
১৯৯০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত চীন, রাশিয়া, ভারত, ইসরাইল এবং ইউক্রেন ছিল মিয়ানমারের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। মিয়ানমারের বেশিরভাগ ফাইটার বিমান, সাঁজোয়া যান, বন্দুক এবং যুদ্ধজাহাজ আসে চীন থেকে। আর যুদ্ধবিমান সরবরাহকারী দেশের মধ্যে রাশিয়া প্রধান। এছাড়া রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে সাঁজোয়া যানও বিক্রি করছে। রাশিয়ার সঙ্গে ২০১৮ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে ছয়টি যুদ্ধবিমানের মধ্যে সম্প্রতি দুটি হাতে পেয়েছে মিয়ানমার।
সংবাদ সূত্রঃ মিয়ানমার নাউ