পেশায় একজন হেয়ার অ্যান্ড মেকআপ আর্টিস্ট শেরিন সিলভা দুই সন্তানের জননী। অন্য সবার মতো তার পরিবারটিকেও শ্রীলংকার চলমান অর্থনৈতিক সংকট চরম বিপাকে ফেলে দিয়েছে। শ্রীলংকার বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম। বিপাকে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ। এখন তাদের জন্য বাজার থেকে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য সংগ্রহ করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেরিন সিলভার ভাষ্যমতে, তাজা দুধ দূরের কথা, চা খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত দুধের গুঁড়াও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শিশুদের ফরমুলা গুঁড়া দুধের দামও এখন আকাশচুম্বী।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে দেয়া বক্তব্যে শেরিন সিলভা বলেন, মনে হচ্ছে আমরা এখন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আছি। খাবারটুকুও আমাদের খেতে হচ্ছে রেশনিং করে। এখনকার সময় ও দিনের কথা চিন্তা করলে গোটা বিষয়টিকে হাস্যকরই মনে হয়।
গত সপ্তাহেই তামিলনাড়ু উপকূলে শ্রীলংকা থেকে আসা ১৬ শরণার্থীকে উদ্ধার করে ভারতীয় কোস্টগার্ড। তারা জানিয়েছে, শ্রীলংকায় খাদ্য, ওষুধ ও নিত্যপণ্যের সংকট, বাজারের অস্থিতিশীল অবস্থা এবং জ্বালানির অভাব সেখানে প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন, সেখানে স্বাভাবিক জীবনযাপনও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি থেকে বাঁচতেই শ্রীলংকা থেকে পালিয়ে এসেছে তারা। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে শ্রীলংকা থেকে শরণার্থীর ঢল আরো বাড়বে।
ইতিহাসের ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে শ্রীলংকায়। লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, সরকারের দুর্বল আর্থিক ও কর ব্যবস্থাপনা, পর্যটন শিল্পের ধস, মহামারীর অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব দেশটির অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধসিয়ে দিয়েছে। জানুয়ারিতেই দেশটিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে রেকর্ড ২৫ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা পরের মাসগুলোয়ও বজায় থাকবে বলে জানিয়েছে শ্রীলংকার সংবাদমাধ্যমগুলো। আমদানি বন্ধ থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার সক্ষমতা হারিয়েছে দেশটির সরকার। দ্বিগুণ-তিন গুণ দাম দিয়েও বাজারে খাদ্য কিনতে পারছে না সাধারণ লংকাবাসী। শিশুখাদ্যেরও অভাব দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতিকে আরো প্রতিকূল করে তুলেছে জ্বালানি পণ্যের অভাব। কেরোসিনের জন্য জ্বালানির দোকানে লম্বা লাইনে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষারত মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। লম্বা এসব লাইন থেকে যাতে কোনো নৈরাজ্য না ছড়ায়, সেজন্য জ্বালানির দোকানগুলোয় সেনাও মোতায়েন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ এখন পুরোপুরি রুদ্ধ।
এরই মধ্যে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতেও শুরু করেছে শ্রীলংকার চলমান সংকট। জাফনা ও মান্নার উপদ্বীপ হয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে পালিয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার। সংকট দ্রুত নিরসন না হলে সামনের দিনগুলোয় এ শরণার্থী সংকট ভয়াবহ রূপ নেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সক্ষমতাও কমে এসেছে শ্রীলংকার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে দেশটির রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩০ কোটি ডলার। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে বড়জোর এক মাসের পণ্য আমদানি করতে পারবে দেশটি। তার ওপর দেশটিকে এ বছরের মধ্যেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে ৪০০ কোটি ডলারের মতো।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও ওষুধের মতো অপরিহার্য পণ্য আমদানি করতে না পেরে শ্রীলংকার আজকের অবস্থা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে জ্বালানির অভাবে দেশটির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। যেটুকু উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে বাসাবাড়ি ও কারখানাগুলোয় দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে মাত্র ৪ ঘণ্টা করে। বাকি ২০ ঘণ্টা ব্ল্যাক আউটেই থাকছে গোটা শ্রীলংকা।
প্রয়োজনীয় মুদ্রণ উপকরণের অভাবে দেশটির সংবাদপত্রগুলোর এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। যেগুলো টিকে রয়েছে সেগুলো কোনোমতে সংক্ষিপ্ত কলেবরে প্রকাশিত হচ্ছে। কাগজের অভাবে দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এখন পরীক্ষা নেয়াও বন্ধ।
দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মীরা বলছেন, চলমান সংকটের ধাক্কা দেশটির দরিদ্র লোকজনকেই বইতে হচ্ছে বেশি। বিশেষ করে প্রান্তিক সংখ্যালঘু ও শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শ্রীলংকাজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিদিনই বিক্ষোভে উত্তাল হচ্ছে দেশটির রাজপথ।
সংকট যে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে সে বিষয়টি স্বীকার করছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেও। তার ভাষ্য অনুযায়ী, দেশটির রিজার্ভ সংকটের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বাণিজ্য ঘাটতি। শ্রীলংকায় বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। দেশটির অর্থনীতির পতনকে ত্বরান্বিত করেছে পর্যটন খাতের ধস। শ্রীলংকার মোট জিডিপিতে খাতটির অবদান ১০ শতাংশ। ২০১৯ সালের ইস্টার বোমা হামলা এবং এর ঠিক অব্যবহিত পরেই মহামারীর প্রাদুর্ভাব খাতটিকে চরম মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০১৯ সালেও দেশটির পর্যটন খাত থেকে আয় হয়েছিল ৭৫০ কোটি ডলার। গত বছর তা দাঁড়ায় ২৮০ কোটি ডলারে। এছাড়া গত বছর দেশটির কৃষি খাতে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ নিষিদ্ধ হওয়ায় দেশটির প্রধান রফতানি পণ্য চা উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রিজার্ভ সংকট আরো জোরালো করে তোলায় ভূমিকা রেখেছে।
সংবাদ সূত্রঃ ডয়চে ভেলে