একে একে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা আসছে, প্রথমে আফগানিস্তান, পরে ইরাক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরাকে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের অবশিষ্ট যুদ্ধসেনা চলতি বছরের শেষ নাগাদ সে দেশ থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমির সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেন এই ঘোষণা দেন। ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব যুদ্ধসেনা প্রত্যাহারের ফলে অঞ্চলটির শক্তিধর দেশ ইরান লাভবান হবে কি না, তা খতিয়ে দেখেছে বিবিসি অনলাইন।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয় প্রায় ১৮ বছর আগে। ২০০৩ সালের এই আগ্রাসনে সাদ্দাম হোসেনের শাসনের পতন হয়। আগ্রাসন-পরবর্তী ইরাকে ১ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন সেনা ছিল। এখন দেশটিতে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন নিয়মিত মার্কিন সেনা রয়েছেন। এ ছাড়া আছে কিছুসংখ্যক বিশেষ বাহিনীর সদস্য, যাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা অজানা।
ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা দিচ্ছেন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সামরিক সহায়তা। ইরাক সরকার বছর কয়েক আগে ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) পরাজিত করার ঘোষণা দিলেও দেশটিতে এখনো জঙ্গিগোষ্ঠীটির উদ্বেগজনক তৎপরতা রয়েছে। বিভিন্ন সময় আইএসের চালানো রক্তক্ষয়ী হামলা তার প্রমাণ। ফলে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা একদিকে যেমন আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছেন, অন্যদিকে ইরাকি বাহিনীকে জঙ্গিবিরোধী লড়াইয়ে সক্ষম করে তুলছেন।
মার্কিন সেনাদের ইরাকে উপস্থিতি নিয়ে সে দেশে জোর বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইরান-সমর্থিত রাজনীতিক ও মিলিশিয়ারা চান, সব মার্কিন সেনা ইরাক থেকে দ্রুত চলে যাক।
ইরাকের রাজধানী বাগদাদের বিমানবন্দরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের অভিজাত রেভল্যুশনারি গার্ডসের কুদস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি নিহত হন। একই হামলায় ইরাকের শিয়াপন্থী শীর্ষ মিলিশিয়া কমান্ডারও নিহত হন। এই ঘটনার পর ইরাক থেকে মার্কিন সেনা হটানোর ব্যাপারে ইরান-সমর্থিত রাজনীতিক ও মিলিশিয়ারা তাঁদের তৎপরতা জোরদার করেন।
ইরাকে মার্কিন সেনা অবস্থান লক্ষ্য করে রকেট ও ড্রোন হামলার পরিমাণ সম্প্রতি বেড়ে যেতে দেখা গেছে। এই হামলার জন্য ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরাকের যেসব রাজনীতিক কোনো পক্ষে নেই, তাঁরাও চান, তাঁদের দেশ বিদেশি সেনামুক্ত হোক। বিদেশি সেনা উপস্থিতির বিষয়টি তাঁরাসহ ইরাকের সাধারণ জনগণের মধ্যে ‘দখলদারি’ অব্যাহত থাকার মনোভাব তৈরি করেছে।
প্রতিবেশী ইরান ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হোক, তা আরও বেশি করে চায়। কারণ, ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে তা তেহরানের জন্য সুবিধাজনক হয় বলে বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়।
ইরান ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর তার প্রতিবেশী দেশগুলো তথা মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন বাহিনীকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে। তেহরানের এই চেষ্টার মূলে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তি হওয়ার বাসনা। এই ইচ্ছেপূরণে যুক্তরাষ্ট্র বাধা হয়ে থাকুক, তা কখনো চায়নি ইরান। কিন্তু তখন এই কাজে ইরান খুব কমই সফল হয়।
ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতন হলে দেশটির শিয়া রাজনীতিক ও মিলিশিয়াদের ওপর উন্মুক্ত হয় তেহরানের প্রভাব বিস্তারের পথ। এই কাজে ইরান ইতিমধ্যে অনেকটা সফল। ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা ইরাকে বেশ শক্তিশালী। অন্যদিকে, ইরাকের পার্লামেন্টেও ইরানপন্থীদের অবস্থান শক্ত।
অনেক দিন ধরেই ইরান আশায় আছে, তারা যদি প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতার মাধ্যমে চাপ অব্যাহত রাখে, তাহলে কখনো না কখনো তারা সফল হবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি সরাতে বাধ্য করতে পারবে।
বিবিসি বলছে, ইরাকে মার্কিন উপস্থিতি নিশানা করে রকেট ও ড্রোন হামলা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইরানের একটা ‘খেলা’ হিসেবে দেখা হয়। আবার ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে সাধারণ ইরাকিদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদে ইরানের সমর্থন এই কৌশলেরই অংশ। ইরাকে ইরানের কৌশল কাজে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইরাকে মার্কিন যুদ্ধসেনাদের অভিযানের সমাপ্তি ঘটলে তা আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের খেলায় ইরানকে সুবিধা দেবে।
সংবাদ সূত্রঃ বিবিসি অনলাইন