মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না

শত শত শিশু, নারী ও পুরুষকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উৎখাতের জন্য ধারাবাহিকভাবে এভাবে মানুষ হত্যা করেছে। তারা নির্বিচারে নৃশংস উপায়ে, পিশাচের মতো ধর্ষণ করেছে কিশোরী, যুবতী ও নারীদের। এরপর তাদেরকে হত্যা করেছে। পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি। এ মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ রোহিঙ্গাদের উগ্রপন্থি করে তোলা হচ্ছে।

এ জন্য মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিত এবং যারা এসব অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের বিচার করতে হবে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। তাদেরকে জানিয়ে দিতে হবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। বুধবার প্রকাশিত ৪৭ পৃষ্ঠার নতুন রিপোর্টে এসব কথা বলেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

এতে বলা হয়, সেখানে ২৫ শে আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৫ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু, নারী, পুরুষ পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। ‘মাই ওয়ার্ল্ড ইজ ফিলিশড’ রোহিঙ্গা টারগেটেড ইন ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি ইন মিয়ানমার- শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কিভাবে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক, সুসংগঠিত উপায়ে নির্মম অভিযান চালিয়েছে। কয়েক ডজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে এই রিপোর্টে। তারা বলেছেন, ভয়াবহ এসব অপরাধের সঙ্গে মিয়ানমার আর্মির ওয়েস্টার্ন কমান্ড, ৩৩তম লাইট ইনফ্যানট্রি ডিভিশন ও বর্ডার গার্ড পুলিশ সহ স্পেশাল ইউনিটগুলো জড়িত।

এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, এই নৃশংস অভিযানে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা রোহিঙ্গাদের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। দৃশ্যত এর উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে দেশ থেকে চিরতরে বিদায় করে দেয়া। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতায় যে শরণার্থী সঙ্কট তৈরি হয়েছে এ অঞ্চলে তা অনেক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। মিয়ানমারের এই হায়েনার মতো অপরাধ সেখানে সুবিচারের পথ বহুদূর এমনটাই নির্দেশ করে। তবে যারা এর জন্য যারা দায়ী তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতায় আনতে হবে। লজ্জাজনক আরেকটি আভ্যন্তরীণ অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নিয়ম লঙ্ঘনকে অনুমোদন দেয়া যায় না। সেনা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং’কে অবশ্যই অবিলম্বে নৃশংক কর্মকা- থেকে রিবত রাখতে হবে তার সেনাদের। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নিজস্ব ওয়েব সাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, অ্যামনিস্টি নৃশংসতার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য, স্যাটেলাইটের ছবি ও ডাটা, ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করেছে প্রমাণ হিসেবে। সব প্রমাণ বলে দেয় হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষ ব্যাপক ও পর্যায়ক্রমিক হামলার শিকারে পরিণত হয়েছেন। তারা মানবতা বিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছেন। রাখাইনে চলমান নৃশংসতায় অ্যামনেস্টি কমপক্ষে এমন ৬টি অপরাধ প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, গণহত্যা, জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা, নির্যাতন, গণধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা, নিপীড়ন ও অন্যান্য অমানবিক কর্মকা- যেমন খাদ্য ও জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন জিনিসের যোগান বন্ধ রাখা। কমপক্ষে ১২০ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের স্বাক্ষের ওপর ভিত্তি করে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

এর ভিত্তিতে রাখাইনে সরেজমিন তদন্তের জন্য পূর্ণাঙ্গ সুবিধা দেয়ার দাবি করেছে অ্যামনেস্টি। এমন আহ্বান জানানো হয়েছে সরকার ও আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (আরসা) প্রতি। এ ছাড়া তারা বার বার জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ও অন্য নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের রাখাইনে অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরসার ২৫ শে আগস্ট হামলার কয়েক ঘন্টা পরে এবং কয়েক দিনের মধ্যে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় উগ্রপন্থিরা। তারা রাখাইনের পুরো উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলো ঘেরাও করে ফেলে। এ অবস্থায় শিশু, নারী ও পুরুষরা গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে। তাদেরকে লক্ষ্য করে পুলিশ বা সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে গুলি করতে থাকে। হত্যা করে তাদেরকে। এতে মারাত্মক আহত হন কয়েক শত মানুষ।

যারা বেঁচে আছেন, তারা বলেছেন, দৌড়ে পালিয়েছেন পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে বা ধানের ক্ষেত্রে। সেনারা চলে না যাওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে পালিয়ে ছিলেন। পঙ্গু, বিকলাঙ্গরা এভাবে পালাতে পারেন নি। তাদেরকে ঘরের ভিতরে রেখেই সেনারা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে জীবন্ত হত্যা করেছে। এমন ঘটনা ঘটেছে মংডু, রাথেডাং ও বুথিডাং এলাকার অনেক গ্রামে। কমপক্ষে এক ডজন করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে এমন ৫টি গ্রাম প্রামাণ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছে অ্যামনেস্টি। এ গ্রামগুলো হলো চেইন কার লি, কোই তান কাউক, চুট পাইন, ইন ডিন, মিন গাই। চুট পাইন গ্রামে গণহত্যা থেকে বেঁচে এসেছেন ১৭ জন রোহিঙ্গা। তাদের সাক্ষাতকার নিয়েছে অ্যামনেস্টি। এর মধ্যে ৬ জন গুলিতে আহত। এদের আবার সবাই তাদের পরিবারের কমপক্ষে একজন করে সদস্য হারিয়েছেন। কেউবা অনেককে হারিয়েছেন।

তারা বর্ণনা করেছেন কিভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অন্যদের সহায়তায় নৃশংসতা চালিয়েছে। এর মধ্যে একজন ফাতিমা (১২)। সে অ্যামনেস্টির কাছে বলেছে, পিতামাতা, আট ভাইবোন ও দাদীকে নিয় বাড়িতেই ছিল সে। এক পর্যায়ে তারা দেখতে পায় গ্রামের অন্যপাশে আগুন জ্বলছে। তা দেখে তারা বাড়ি ছেড়ে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু পিছন থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ব্যক্তিরা তাদের দিকে গুলি করতে থাকে। এতে তার পিতা ও ১০ বছর বয়সী এক বোন গুলিবিদ্ধ হয়। ফাতেমারও গুলি লাগে ডান পায়ে, হাঁটুর একটু উপরে। ফাতেমা বলে, এতে আমি পড়ে যাই। আমার প্রতিবেশীরা আমাকে তুলে নেন। তারপর এক সপ্তাহ দৌড়ানোর পর বাংলাদেশে এসে চিকিৎসা পেয়েছি। চুট পাইনে গুলিতে নিহত হয়েছে আমার মা ও বড় ভাই। গুলিতে ফাতেমার ক্ষত স্থানের ছবি তুলে তা ফরেনসিক মেডিকেল বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে অ্যামনেস্টি।

তারা বলেছেন, এটা বুলেটের ক্ষত। বাংলাদেশের ডাক্তারা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষতই পিছন থেকে গুলি চালানোর। কোই তান কাউক গ্রামের ৭৭ বছর বয়সী সোনা মিয়া। ২৭ শে আগস্ট সেনাবাহিনী যখন তার গ্রাম ঘিরে ধরে গুলি চালানো শুরু করে তখন তিনি বাড়িতেই ছিলেন। তার বড় মেয়ে রায়না খাতুন (২০)। তিনি পঙ্গু। হাঁটতে পারেন না। কথাও বলতে পারেন না। তাই তাকে কাঁধে তুলে নেন তারই এক ভাই। তারপর পুরো পরিবার পাহাড়ের দিকে হাঁটা শুরু করেন। যখন তারা খুব কাছ থেকে গুলির শব্দ পান তখন তারা রায়নাকে এক রোহিঙ্গার বাড়িতে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তাকে ফেলেই আসেন সেই বাড়িতে। সোনা মিয়া বলেন, আমি তাকে বলে এসেছি, তুমি এখানে থাকো। আমি পরে এসে নিয়ে যাবো। পাহাড়ে আসার পর আমরা ওই বাড়িটি জ্বলতে দেখতে পাই। এটা একটু দূরে ছিল, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। সেনারা বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। শেষ বিকেলের দিকে সেনাবাহিনী ওই গ্রাম চেড়ে যায়। সোনা মিয়ার এক ছেলে তখন ওই বাড়িতে ফিরে যান। তিনি খুঁজে পান রায়নার পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। সেখানেই কবর খুঁড়ে তাকে দাফন করেন তারা। সেনাবাহিনীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন ৭ জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছে অ্যামনেস্টি।

অ্যামনেস্টির তিরানা হাসান বলেছেন, মিয়ানমার সরকার বার বার অস্বীকার করার মাধ্যমে এই গণহত্যা ও ভয়াবহতা আক্ষরিক অর্থেই এড়িয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তি, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অনেক গবেষলা তাদের বিরুদ্ধে সেই ভয়াবহতা প্রকাশ করে দিয়েছে। তাই এখন সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যবস্থা নেয়ার। তাদে উচিত এই সহিংসতা বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নেয়া। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়ে, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, নৃশংসতার জন্য টার্গেটেড ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবরোধ দিয়ে তাদের প্রতি কড়া বার্তা দিতে হবে যে, রাখাইনে মানবাধিকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অপরাধ সহ্য করা হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিশ্চিত করতে হবে যে, সেনাবাহিনীর এই জাতি নিধন আইনসম্মত নয়,। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশকে উৎসাহিত ও সমর্থন দেয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪২ ঘণ্টা, ১৮ অক্টোবর  ২০১৭

লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/কেএসপি

Scroll to Top