পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও শীর্ষ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট করপোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ২০১৫ সালে টেডএক্সে দেওয়া এক বক্তৃতায় একটি সংক্রামক ভাইরাস ও আসন্ন মহামারির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তা অনেকটাই মিলে যায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে। বিল গেটস এবার নতুন আরেকটি অনিবার্য বিপর্যয়ের আভাস দিলেন। গেটস নোটস নামের ব্লগে ৪ আগস্ট প্রকাশিত তাঁর লেখা কলামের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো আজ।
কোভিড-১৯ ভয়ানক। তার চেয়েও ভয়ানক হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তন। তবে বর্তমান সংকট থেকে নেওয়া কিছু শিক্ষা আমাদের আগামীর বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করতে পারে।
বৈশ্বিক এক বিপর্যয়ে পুরো দুনিয়া থমকে গেছে। এত মৃত্যু, বাড়ি থেকে বের হওয়ার এমন আতঙ্ক, আর এমন অর্থনৈতিক সংকট আগে কোনো প্রজন্ম দেখেনি। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে প্রভাব ফেলেছে এই বিপর্যয়।
হ্যা, আমি কোভিড-১৯ নিয়েই কথা বলছি। কিন্তু কয়েক দশকের মধ্যেই ঠিক এমনভাবেই আরেকটি বৈশ্বিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে বিশ্ব, সেটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। মহামারি যতটা ভয়াবহ হয়ে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তন হবে এর চেয়েও ভয়ংকর।
আমি বুঝি, এই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যার কথা চিন্তা করা কঠিন। যখন কোনো বিপর্যয় আসে, তখন মানুষ শুধু সেই সংকটই সবার আগে মোকাবিলা করতে চায়। এখন তো কোভিড-১৯–এর মতো বৈশ্বিক মহামারির মুখোমুখি পুরো পৃথিবী। কিন্তু মূল কথা হলো, দিন দিন বাড়তে থাকা তাপমাত্রার হার দেখে মনে হচ্ছে আরও একটি বিপর্যয় খুব বেশি দূরে নেই। এখন এর থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হলো জলবায়ু রক্ষায় আমাদের উদ্যোগের গতি আরও বাড়াতে হবে। এখন যেমন বিশ্ব লড়ছে নতুন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এবং ধীরে ধীরে পৃথিবী সেরেও উঠতে শুরু করেছে, সেভাবেই এই মুহূর্ত থেকে আমাদের জলবায়ুর বিপর্যয় রুখতে কাজ শুরু করতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে আমাদের নতুন নতুন উদ্ভাবনের দিকে ঝুঁকতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
এরই মধ্যে হয়তো খেয়াল করেছেন, বিশ্বব্যপী অর্থনৈতিক গতিশীলতা কমে যাওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কম। তবে এটা সত্য যে জলবায়ুর বিপর্যয় মোকাবিলায় গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমার এই হার খুবই নগণ্য।
বিশ্লেষকেরা এই সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির হিসাবে, গ্যাস নিঃসরণ কমেছে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ এ বছর আমরা আনুমানিক ৪৭ বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ করব, গত বছর যেটা ছিল ৫১ বিলিয়ন টন।
এই হারে যদি প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়, তাহলে আমরা এর থেকে সুফল পাব। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, প্রতিবছর তো আর এমনটা সম্ভব না। ভেবে দেখুন তো, মাত্র ৮ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য কী কী মূল্য পরিশোধ করতে হলো আমাদের। ৬ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারাল এবং ১ কোটির বেশি মানুষ কাজ হারাল। গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় এই বছর একই সময়ে রাস্তায় গাড়ি চলাচল করেছে অর্ধেকের কম। মাসের পর মাস ধরে বন্ধ ছিল বিমান চলাচল।
আপনারা যদি আঁচ পেতে চান যে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের কী পরিমাণ ক্ষতি করবে, তাহলে কোভিড-১৯–এর প্রভাবটা দেখুন, জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষতির প্রভাব হবে এর চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী। এই মহামারিতে যত প্রাণহানি আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ কমানো না গেলে ভবিষ্যতে নিয়মিত এই পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে।
অন্যভাবে বললে, ২০৬০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তন ঠিক কোভিড-১৯–এর মতোই প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। আর ২১০০ সাল নাগাদ এটা হয়ে যাবে ৫ গুণ বেশি ভয়াবহ।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও এই চিত্রটা স্পষ্ট। জলবায়ু বিপর্যয় আর কোভিড-১৯–এর প্রভাব হয়তো কিছু কমবেশি হতে পারে, যা নির্ভর করবে আমরা কোন ধরনের অর্থনৈতিক মডেল ব্যবহার করছি তার ওপর। কিন্তু পরিণতি সব একই থাকবে—আগামী এক বা দুই দশক পর থেকে জলবায়ু বিপর্যয় ঠিক কোভিড-১৯–এর মতো করেই পৃথিবীকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর এই পরিমাণ ক্ষতির মুখে পৃথিবী প্রতি ১০ বছর পরপরই পড়বে। এই শতকের শেষে গিয়েও যদি এভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে, তাহলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হবে ভয়ংকরতম।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় কতটা ভয়াবহ হবে, আলোচ্য বিষয় আসলে এটা নয়। এখানে আলোচনার বিষয় হলো, আমরা যদি আদৌ কোভিড-১৯ থেকে কোনো শিক্ষা নিয়ে থাকি, তাহলে এখন থেকেই সেটা প্রয়োগ করে জলবায়ু বিপর্যয় এবং এর মোকাবিলায় আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের নিষ্ক্রিয়তার ফল কী হতে পারে, তা অনুধাবন করতে হবে। কোভিড-১৯ থেকে পাওয়া শিক্ষা নিয়ে আমরা আরও জীবন বাঁচাতে পারব এবং ভয়ংকরতম পরিণতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। বর্তমান সংকট আমাদের পরবর্তী বিপর্যয়ের ব্যাপারে এখন থেকেই সাবধান করছে।
আমরা যা করতে পারি
১. বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনকে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। সামান্য পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ পরিমাণ কমার কারণে একটা বিষয় পরিষ্কার হলো, শুধু গাড়ি বা বিমান চলাচল থামিয়ে আমরা কার্বন নিঃসরণ পুরোপুরি কমাতে পারব না।
অবশ্যই আমাদের যতটা সম্ভব ততটা জ্বালানি সাশ্রয় করা উচিত। আমি যেমন এখন সাশ্রয় করতে পারি। আমার বিশ্বাস, মহামারি কেটে গেলে অনেকেই আমার মতো যতটা সম্ভব শারীরিকভাবে যাতায়াত কমিয়ে টেলি কনফারেন্সিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
আমাদের আরও জ্বালানি ব্যবহার করা উচিত, তবে অবশ্যই সেটা নিরাপদ হতে হবে। তাই এখন আমাদের যতটা করোনাভাইরাস নির্মূলে নতুন ও আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসাসেবা এবং ভ্যাকসিন প্রয়োজন, ততটাই প্রয়োজন জলবায়ু বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য নতুন সরঞ্জাম ও কৌশল। যেমন জিরো-কার্বন পদ্ধতিতে জ্বালানি উৎপাদন, খাদ্য উৎপাদন, আবাসস্থলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন। সেই সঙ্গে আমাদের আরও প্রয়োজন নতুন শস্যবীজ ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যা মূলত বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাজে আসবে, যারা ক্ষুদ্র পরিসরে চাষাবাস করে।
জলবায়ু পরিবর্তনকে আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জলবায়ু বিজ্ঞান আমাদের শুধু বলে দেয় কেন এই সমস্যার মোকাবিলা এখন থেকেই শুরু করতে হবে, এটা বলে না যে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্যই জলবায়ু বিজ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের অন্য শাখাগুলোর দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
২. দরিদ্র দেশের জন্যও উপযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আমরা এখনো জানি না দরিদ্র দেশগুলোতে কোভিড-১৯ কতটা ভয়ংকরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তবে আমার ধারণা, মহামারি কেটে গেলে এই দেশগুলো আরও বাজেভাবে ভেঙে পড়বে। একই অবস্থা হবে জলবায়ু বিপর্যয়ের সময়ও। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ভোগ করবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট।
আরেকভাবে বলা যায়, জলবায়ু বিপর্যয় দরিদ্র দেশগুলোকে কোভিড-১৯–এর চেয়েও বাজেভাবে ভোগাবে। অথচ জলবায়ুর ক্ষতিকে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ করে সবচেয়ে কম। যে দেশগুলো জলবায়ুর ক্ষতি সবচেয়ে বেশি করছে তাদের দায়িত্ব এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ বের করার।
৩. শুরু হোক এখন থেকে। নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন হয়তো আগামী বছর নাগাদ আমরা পেয়ে যাব। কিন্তু করোনার মতো দুই বছরেই জলবায়ু বিপর্যয়কে নির্মূল করা যাবে না। কয়েক দশক লেগে যাবে নিরাপদ জ্বালানি ব্যবহার করে প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিতরণ করতে।
জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধে আমাদের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এখন থেকেই জিরো কার্বনসম্পন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। নতুন ও টেকসই উদ্ভাবন সহজলভ্য করতে হবে এবং দরিদ্র দেশগুলো যেন পৃথিবীর বাড়তে থাকা তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে সাহায্য করতে হবে।
যদিও আমি ইদানীং কোভিড-১৯ নিয়ে বেশি কাজ করছি। তবে এর মধ্যেও নিরাপদ জ্বালানি ব্যবহার করে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উৎপাদনে বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। এমন কিছু কর্মসূচির আয়োজন করছি, যা বিশ্বজুড়ে উদ্ভাবনের উৎসাহকে এগিয়ে নেবে। কমিয়ে আনবে জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা।
কিছু রাষ্ট্র ও ব্যক্তিও আমার মতো কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাঁরা তহবিল গঠন করছেন, নীতিমালা তৈরি করছেন। আমাদের এমন আরও অনেকের দরকার। আমাদের দরকার কোভিড-১৯ মোকাবিলার মতোই দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়ার।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বছরের পর বছর ধরে বলে গেছেন, একটি মারাত্মক মহামারির মুখে পড়বে বিশ্ব। কিন্তু কেউ এর প্রস্তুতি কখনো নেয়নি, যার ক্ষতি এখন আমরা কোনোভাবেই পুষিয়ে উঠতে পারছি না। আর এটাই হলো জলবায়ু বিপর্যয়ের অশনিসংকেত, বর্তমান মহামারি থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।