ক্রিকেটভক্তদের কাছে ইমরান খানের পরিচয় বোলার হিসেবে। পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় এবং অধিনায়ক তিনি। কিন্তু ভালো ব্যাটও করতেন তিনি। ৮৮ টেস্টের ক্যারিয়ারে তাঁর ব্যাটিং গড় ৩৮। এক দিনের ফরম্যাটে ৩৩। একজন সফল বোলারের জন্য এই ব্যাটিং গড় বাড়তি আকর্ষণ।
বোলিং রাজনীতির মাঠের বিরোধী দলের মতো। লক্ষ্য থাকে একটাই, প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা। সেই তুলনায় ব্যাটিংয়ে অনেক পূর্বাপর ভাবতে হয়। কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো রক্ষণাত্মক সতীর্থের কথা, পরের ব্যাটসম্যানদের কথা বহু বিবেচনা থাকে।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে রাজনীতির মাঠেও ইমরান ‘বোলার’ হিসেবে দুর্দান্ত ছিলেন। রাজনীতিতে নবীন ও নবিশ হয়েও অল্প সময়ে পাকিস্তানের প্রধান দুই ‘রাজবংশ’ পাঞ্জাবের শরিফ এবং সিন্ধুর ভুট্টোদের বিধ্বস্ত করে ‘ব্যাটিং’য়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতির ব্যাটিং পর্বে ইমরান খুব কোণঠাসা অবস্থায় আছেন। দুবছর পেরোয়নি এখনো প্রধানমন্ত্রিত্বের। নিজের ইনিংস নিয়ে তাঁর কণ্ঠে আগের মতো উদ্ধত আশাবাদ নেই। ‘নয়া পাকিস্তান’-এর কথাও কম বলছেন। বরং ইসলামাবাদে কান পাতলে ‘মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা’র গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে আবারও। এই ‘ওয়ান’ এবার খোদ ইমরান এবং তাঁকে মাইনাসের কথা ভাবা হচ্ছে খোদ তাঁরই গড়া দল পাকিস্তান তেহেরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) থেকে! পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ক্রিকেট টিমটার মতোই দেশটির রাজনীতিও ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তায় ভরা’ এক পিচ্ছিল ক্রিজ বটে।
দুবছর না পেরোতেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের শঙ্কা?
রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ‘বোলিং’য়ের সময় ইমরান ফিল্ডিংয়ে ‘ডিপ স্টেইট’ থেকে ভালো সহায়তা পেয়েছিলেন। ব্যাটিং একাদশে তারাই তাঁর অরাজনৈতিক সহযোগী বলে দেশটির মানুষের একাংশের ধারণা। পাকিস্তানে এটা অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এটাকে সেখানে জরুরি মনে করা হয়। তবে ‘ব্যাটসম্যান’ ও ‘ফিল্ডার’দের সেই সম্পর্কে চিড় ধরেছে বলে মনে হচ্ছে। এই অনুমানের বড় ভিত্তি ৩০ জুন পার্লামেন্টে দেওয়া ইমরানের ভাষণ। ৪৪ মিনিটের ভাষণে ইমরান নিজেই জানালেন মাইনাস ওয়ানের শঙ্কার কথা। আবার এর সত্যতাও নাকচ করেছেন। এ রকম ‘নাকচ’ দিয়েই অতীতের বেদনাদায়ক সব পরিবর্তন পর্ব শুরু হয়েছিল। ইমরানের কণ্ঠে এ রকম শঙ্কার কথা শুনে তাঁর দলেই সংগঠক পর্যায়ে একে অপরকে অবিশ্বাস করার প্রবণতা উসকে উঠেছে। ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশের জন্য’ একে অপরকে দোষারোপও করেছেন কেউ কেউ। প্রচারমাধ্যমে সেসব সংবাদ এসেছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আসাদ ওমর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরাইশীর সঙ্গে মধ্য সারির অন্যদের বনিবনা হচ্ছে না। এ দুজনকে ঘিরে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে, যদিও দুজনেরই ইমেজ ভালো।
মাইনাস ওয়ানের দীর্ঘ ছায়া
পাকিস্তানে ‘মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা’য় রাজনৈতিক অঙ্কের সমাধান বেশ পুরোনো। এই নিরীক্ষার শুরু এবং শেষ গৎবাঁধা। যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনকালে বিপুল আশাবাদ তৈরি হয়। দু-তিন বছর পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের অভাবে সমাজে হতাশা বাড়তে থাকে। ঠিক তখনই সব ব্যর্থতার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়ী করা শুরু হয়। পাশাপাশি শুরু হয় নানান কৃত্রিম অস্থিতিশীলতা। একপর্যায়ে সেই সরকারপ্রধান ধরাশায়ী হন। কেউ দেশে থাকতে পারেন, কেউবা পালিয়ে যান। দলটিকে অবশ্য কিছু ক্ষয়ক্ষতিসহ টিকে থাকতে দেওয়া হয়! বিশেষ করে দ্বিতীয় সারির নেতারা পুরো অক্ষত থাকেন। ভবিষ্যতে এঁদেরই ব্যবহার করা হয় অন্য সরকারের বিরুদ্ধে।
মাইনাস ওয়ানের এই ইতিহাস ও প্রকৌশলবিদ্যা সাম্প্রতিক সরকারপ্রধানদের ক্ষমতার প্রথম দিন থেকে অনিশ্চয়তা ও দৌড়ের ওপর রাখছে। সামরিক শাসনের ‘ঐতিহ্য’কে থামাতে পারলেও দেশটির রাজনীতিবিদেরা এই ‘নিরীক্ষা’ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
আগস্টে ইমরানের প্রধানমন্ত্রিত্বের দুবছর হবে। চাওয়া-পাওয়া-প্রতিশ্রুতির হিসাবের জন্য তাঁকে আরও কিছু সময় দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রীই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্লাস-মাইনাসের কথা জানাতে শুরু করেছেন। দেশের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এটা খারাপ বার্তা। ‘মাইনাস ওয়ান’ খড়্গের মাধ্যমে মূলত দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান দুর্বল করে রাখা হয়। বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেও অনেক সরকার এই খড়্গের ভয়ে আর্থসামাজিক জরুরি সংস্কারে হাতে দিতে পারে না। যেকোনো সংস্কার প্রভাবশালী কায়েমি স্বার্থবাদীদের আঘাত করে। পাকিস্তানে এ রকম সময় চিরচেনা কিছু ঘটনা ঘটে। সামান্য অজুহাতে রাস্তায় দখল নিতে শুরু করে কিছু সংগঠন। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে প্রচারমাধ্যম গরম হয়ে ওঠে। নাটকীয় সব রায় দিতে থাকেন আদালত। চাঞ্চল্যকর খুনখারাবি বেড়ে যায়। জনগণ সরকারের ওপর বাজি ছেড়ে দেয়। ইমরানের তৃতীয় বছর থেকে পাকিস্তানে এ রকম অবস্থার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে ক্রমে। যেমনটি ঘটেছিল নওয়াজ শরিফের শাসনের মেয়াদ কমাতে ইমরানকে সামনে রেখে।
ইমরানের সফলতা-ব্যর্থতা
মাত্র দুবছর যেকোনো রাজনৈতিক সরকারকে মূল্যায়নের জন্য বেশি সময় নয়। অর্থনীতির দুঃসময়ে ইমরান সরকার গড়েছিলেন। দেড় বছরের মাথায় শুরু হয় ভাইরাসের আঘাত। ফলে দেশটি এখন চরম ব্যথা-বেদনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ঋণ ও বেকারি, দুটোই ঊর্ধ্বমুখী।
টিম-ইমরান চেষ্টা করেনি, বলা যাবে না। কিন্তু সময়টা পিটিআইয়ের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। বড় অর্থনৈতিক মিত্র চীনও কোভিড আর যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় ব্যস্ত। এর ফলে সাহায্যের উৎস কমে গেছে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রুখতেও সরকার দক্ষতার পরিচয় দেয়নি। ইসলামাবাদে এমন শোনা যায়, ‘লকডাউন’ নিয়ে ডিপস্টেইটের সঙ্গে বিরোধ বেধেছে সরকারের।
প্রধান দুই বিরোধী দল শরিফদের মুসলিম লিগ এবং ভুট্টোরা এই পরিস্থিতি থেকে নির্মমভাবে সুযোগ নেবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। ইমরানও শরিফদের মোটেই শান্তি দেননি বিরোধী দলে থাকার সময়। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে মাইনাসে ইমরানের অবদান কম ছিল না। ভুট্টোদের অভিভাবক আসিফ আলী জারদারিও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ খুঁজছেন। মাইনাস ওয়ানের গুঞ্জন ইতিমধ্যে এসব দলের কর্মীদের জন্য টনিকের মতো কাজ করছে।
বিরোধী দলের জন্য পুরোনো ফর্মুলা মঞ্চায়নে বড় সমস্যা হলো, ব্যক্তি ইমরানের কয়েকটি প্লাস পয়েন্ট রয়েছে। কথামতো ‘নয়া-পাকিস্তান’ গড়তে পারেননি, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতি করছেন না তিনি। সে রকম নজির মিলছে না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেও তাঁকে আন্তরিকভাবে চেষ্টারত মনে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে তাঁর সরকার ইতিবাচক কূটনীতির জন্য সুনামও কুড়িয়েছে বেশ।
এসব অবশ্য স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয় না। অতীতের মাইনাস ওয়ান সংস্কৃতি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিক্ততা ও ব্যক্তিগত আক্রোশ অতি তীব্র মাত্রায় রেখেছে। ফলে ‘শক্তিকেন্দ্র’ থেকে ইঙ্গিতমাত্রই ইমরানের বিরুদ্ধে সব শক্তির ঐক্যবদ্ধ হতে ইস্যুর অভাব হবে না। যদিও এ রকম যেকোনো আয়োজন পাকিস্তানের কোনো রোগই সারাবে না।
অনিশ্চয়তায় মোড়ানো ভবিষ্যৎ
গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও মৈত্রীর দ্বান্দ্বিকতা দরকার হয়। কোথায় দলের স্বার্থের শেষ এবং কোথায় দেশের স্বার্থের শুরু, সেই দাগ সযত্নে রক্ষা করা না গেলে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিই লাভবান হয়।
পাকিস্তানে দেশের কোনো সংকটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের পরিসর গড়ে ওঠেনি। হয়তো সচেতনভাবেই সেটা গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক এলিটদের কাছে ‘জাতীয় স্বার্থ’ সামান্যই গুরুত্ব পায়। সবই দেখা হয় ‘দলীয় স্বার্থ’-এর জায়গা থেকে।
নবীন রাজনীতিবিদ ইমরানকে একসময় সেসব নিয়ে না ভাবলেও চলেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অর্থনীতি সামাল দিতে তাঁর যে বিরোধী দলের সহযোগিতা দরকার হবে, সেটা হয়তো দুবছর আগেও ভাবেননি তিনি। গত ২৩ মাসে প্রধান দুই বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতার কোনো সম্পর্ক গড়তে পারেনি তাঁর দল।
নিজ দলেও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারেননি ইমরান। এখনো পিটিআই মানে ইমরান, ইমরান মানে পিটিআই। যৌথ নেতৃত্ব দেখা যায়নি গত দুবছরে। সব বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। বলাবাহুল্য, এ রকম সব সিদ্ধান্ত ভালো ফল দেয়নি। এতে সরকারের যেকোনো বিভাগের ব্যর্থতাই ইমরানের জন্য ‘নো-বল’ হচ্ছে। জেনারেলরাও তাঁর ‘ব্যর্থতা’র ভাগ নিতে রাজি হবেন না। যদিও তাঁর সরকারের সব সফলতা এত দিন জেনারেলদের সফলতা হিসেবেও প্রচারিত হতো!
তবে ইমরান সমর্থকদের জন্য ভরসা হলো, ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় তিনি। দুর্নীতিমুক্ত ইমেজ এবং ক্রিকেট সফলতার ঐতিহ্য এখনো বড় পুঁজি তাঁর। যদিও সামনের মাসগুলো তাঁর জন্য অনিশ্চয়তায় মোড়ানো হবে। দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে আস্থা-বিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বোলার ইমরান হয়তো আগের মতো আর অদৃশ্য ফিল্ডারদের সহায়তা পাবেন না। আর ব্যাটসম্যান হিসেবেও তিনি ব্যর্থ হতে পারেন যদি সতীর্থরা ‘ম্যাচ ফিক্স’ করে থাকেন।
আলতাফ পারভেজ: ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
:প্রথম আলো