কাশ্মীরি কিশোর বোরহান নাজিরের কাঁধে একটি ক্রিকেট বলের আকারে বড় ক্ষত। ভারতীয় দখলদার বাহিনীর নির্বিচার হিংস্রতার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে সে।
তার পরও ১৬ বছর বয়সী বোরহানের তকদির ভালোই ছিল বলা যাবে। কারণ সে বেঁচে আছে।
স্থানীয়রা বলছেন, গত ৫ আগস্ট রাজ্যটির বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা কেড়ে নেয়ার পর চারজন নিহত হয়েছেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে বোরহান বলল, বন্ধুদের সঙ্গে সে হাঁটতে বেরিয়েছিল। দিনটি ছিল ৬ আগস্ট। ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সকে (সিআরপিএফ) এড়িয়ে যেতে তারা ঘুরে গিয়ে দৌড় দেয়।
কিন্তু এক জওয়ান শটগান তুলে নিয়ে তার ডান কাঁধ লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বলে জানায় এই কিশোর।
বোরহানা জানায়, সেনাদের একজন বুট দিয়ে আমার কাঁধ চেপে ধরে গোলাটিকে আরও ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। আরেকজন আমার ঘাড় মটকে দেয়ার চেষ্টা করে। তারা আমাকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করতে চেয়েছে।
এ অবস্থা দেখে যখন কয়েকজন নারী চিৎকার শুরু করেন, তখন সেনারা চলে যায়। পরে প্রতিবেশীরা বোরহানকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেন।
তার বাবা নাজির আহমেদ বলেন, বোরহানের শরীরের বিভিন্ন অংশে চার শতাধিক ছররা গুলি পেয়েছেন চিকিৎসক।
চিকিৎসা প্রতিবেদন দেখে এএফপি বলছে, বোরহানের শরীর থেকে গুলি ও একটি প্লাস্টিক ক্যানিস্টার সরানো হয়েছে।
সিআরপিএফের ইন্সপেক্টর জেনারেল জুলফিকার হাসান বলেন, এমন কোনো ঘটনার প্রতিবেদন তাদের কাছে নেই। কেউ যদি অভিযোগ করেন তবে তদন্ত করে দেখা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কাশ্মীরে ১৯৮৯ সালে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলে হাজার হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শনিবার বলেন, পাকিস্তান সমর্থিত অল্প কয়েকজন লোক বাদে অধিকাংশ কাশ্মীরি স্বায়ত্তশাসন বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
কিন্তু চলতি সপ্তাহে জোরদার করা বিধিনিষেধ সত্ত্বেও উপত্যকাটিতে কয়েক বিক্ষোভ হয়েছে। পাথর ছোড়ার ঘটনাও ঘটেছে বহু।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, কোনো অভিযোগ ছাড়াই শত শত লোককে আটক করা হয়েছে। যাদের মধ্যে হিমালয় অঞ্চলটির শীর্ষ রাজনীতিবিদরাও রয়েছেন।
কাশ্মীর উপত্যকায় ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। যেটি গভীর উদ্বেগের বলে অভিহিত করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাসেলেট।
গত মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতায় নিহত তিন কাশ্মীরির পরিবারের সঙ্গে আলাপ করেছে এএফপি। জানালার শার্সি ভেঙে টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টার রুমের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটলে দুই সন্তানের এক মাও নিহত হয়েছেন।
২৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর সত্যপাল মালিক বলেন, আগের ১০ দিনে সেখানে কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। একই দিন পুলিশ দাবি করছে, বিক্ষোভকারীদের পাথরে এক ট্রাকচালক নিহত হয়েছেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতায় মারাত্মক আহত হওয়ার পর গত ৩ সেপ্টেম্বর আসরার খান নামের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর নিহত হন।
এএফপিকে তার মা শাহেনা বলেন, ৬ আগস্ট শ্রীনগরের নিজেদের বাড়ির পাশেই ক্রিকেট খেলছিল আসরার। তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সেনাবাহিনী।
বাড়িতে ছেলের শোকে বিলাপ করছিলেন তিনি। প্রতিবেশী নারীরাও সেখানে ছিলেন। শাহেনা বলেন, পার্কের কাছে সিআরপিএফের একটি যান এসে থামে। এর পর আসরারের মাথা বরাবর টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে।
‘আমি দেখলাম- টিয়ার গ্যাসের শেলের আঘাতে সে মাটিতে পড়ে গেছে এবং সেনাবাহিনী তাকে গুলি করছে।’
গত ৪ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল কানওয়ার জিৎ সিং বলেন, বিক্ষোভকারীদের পাথরে আসরার নিহত হয়েছেন।
কিন্তু তার হাসপাতালের কাগজপত্র দেখেছে এএফপি। মাথায় মারাত্মক আঘাতের ক্ষত দেখা গেছে তাতে। গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে এতে বলা হয়েছে।
শনিবার লেফটেন্যান্ট কানওয়ার জিৎ সিংয়ের বক্তব্য থেকে সরে এসে ভারতীয় সরকার বলছে, শক্ত ও ভোঁতা বস্তুর আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেটি কী, তা উল্লেখ করেনি।
আসরারের ক্ষুব্ধ বাবা ফেরদাউস আহমেদ একটি ছবি ও এক্স-রে প্রতিবেদন দেখিয়ে বলেন, সেদিন কোনো বিক্ষোভ হয়নি। ওই সেনা কর্মকর্তা নির্জলা মিথ্যা দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, আমার ছেলে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। কিন্তু আমাদের শিশুদের ওপর কী আচরণ করা যাচ্ছে, বিশ্ব যেন সেটি দেখে।