১৩ দিন আগে আমি ধর্ষণের শিকার হই, বলেন ২০ বছর বয়সী আয়েশা বেগম। তার ঠিকানা এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। সপ্তাহখানেক আগেই তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুথিডংয়ের তামি গ্রাম থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে বালুখালী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে মিয়ানমারের সেনাদের বর্বরতার কথা আলজাজিরাকে জানান আয়েশা।
আয়েশা বলেন, ‘আমি আর আমার চার ননদ রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। তখন মিয়ানমারের সেনারা আমাদের বাড়িতে হামলা করে। তারা আমাদের ঘরে ঢুকে জোর করে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায়। ওই সময় আমার সঙ্গে থাকা ছোট সন্তানকে ফুটবলের মতো লাথি মেরে ফেলে দেয় সেনারা।’
‘পরে আমাদের সবাইকে তারা নগ্ন করে। এক সেনা গলায় ছুরি ধরে আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা ধরে আমাদের সবাইকে ১২ জন সেনা একের পর এক ধর্ষণ করে।’
আয়েশা বেগম বলেন, ‘আমি বারবার ভাবছিলাম, তারা আমাকে মেরে ফেলবে। ওদিকে আমি ভয়ে ছিলাম, সেনাদের লাথি খাওয়ার পর আমার সন্তান বোধহয় মারা গেছে। এই ঘটনার পর আট দিন ধরে হেঁটে আমরা বাংলাদেশে আসি। বাংলাদেশে আসার পথে ধর্ষণের শিকার আমার দুই ননদ মারা যায়।’
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় সহিংসতা শুরু হলে খুন, অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদসহ নির্বিচারে রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর অনেককেই হত্যা করে সেনা ও স্থানীয়রা। আবার অনেকেই শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখ এক হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। বাসস্থান, খাবার, শৌচাগার ও চিকিৎসার সংকটে সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। আশ্রয় নেওয়া ওই কিশোরী ও নারীদের অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার। ফলে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত তারা।
শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ধর্ষণের শিকার নারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অনেক কিশোরী ও নারীদের মিয়ানমারের সেনারা ধর্ষণ করেছে এবং ধর্ষণের পর ঘরের ভেতর তাদের আটকে রেখে আগুন লাগিয়ে দেয় সেনারা। শুধু ধর্ষণ নয়, উলঙ্গ করা ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গে পাশবিক নির্যাতন করেছে সেনারা। এখন তাদের দাবি, মিয়ানমারের সেনারা তাদের ওপর যে যৌন নির্যাতন করেছে, সেটার বিচার।
মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধ ও সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করছেন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক পিটার বোকেট।
মিয়ানমারের সেনারা যুদ্ধাপরাধ করছে উল্লেখ করে পিটার বোকেট বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের এমন তথ্য-প্রমাণ আমার কাছে আছে যা মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, আমার ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি খুব একটা হইনি।’
‘রোহিঙ্গা নারীরা ব্যাপক ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধষণের পর অধিকাংশ নারীকেই যে হত্যা করা হয়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
রোহিঙ্গা ধর্ষিত নারীদের চিকিৎসা দিচ্ছে মেডিসিনস স্যানস ফ্রান্ট্রিয়ারস (এমএসএফ)। রোহিঙ্গা নারীরা নিশ্চিতভাবে ব্যাপক ধর্ষণের শিকার হয়েছে উল্লেখ করে এমএসএফের সমন্বয়ক কেইট হুয়াইট বলেন, ‘সহিংসতা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা কমপক্ষে ২৩ জন ধর্ষিতাকে চিকিৎসা দিয়েছি। এদের মানসিক অবস্থা খুবই কাহিল।’
‘ধর্ষিতার লাশ দাফন না করেই পালাই’
তামি গ্রামের আরেক নারী মোহসিনা বেগম বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনারা ঘরে ঢুকে আমাদের ১৯ বছর বয়সী বোনকে তুলে নিয়ে যায়। সে দেখতে খুব সুন্দর ছিল। গ্রামের চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় তাকে ফিরিয়ে আনি। কিন্তু ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত তাকে সেনারা আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে। পরে যখন আমরা পালিয়ে আসতে থাকি তখন রাস্তায় সে মারা যায়। তার লাশ দাফন না করেই আমরা পালিয়ে আসি।’
‘ধর্ষণের পর পেটায়, তারপর আগুন দেয়’
৩০ আগস্ট সহিংসতার শিকার হয় তুলা তোলি গ্রামের রাজুমা বেগম (২০)। তিনি বলেন, ‘সেনারা আমার ছেলেকে কেড়ে নেয়। তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মাটিতে। পরে তার গলা কেটে ফেলে সেনারা।’
‘এরপর আমাকেসহ আরো চার নারীকে একটি ঘরের নিয়ে যায় সেনারা। সেখানে তিনজন নারী, একজন কিশোরী এবং ৫০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা ছিল। ওই বৃদ্ধাকে ছাড়া সবাইকে ধর্ষণ করে সেনারা। দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে দুই সেনা আমাকে ধর্ষণ করে।’
‘ধর্ষণের পর লাঠি দিয়ে তারা আমাদের পেটাতে থাকে। তারা ভাবে আমরা মারা গেছি। এর পরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘরের ভেতর আমাদের আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়।’
‘মনে হচ্ছিল, আমি মারা যাচ্ছি’
রাখাইনের বুথেডংয়ের চপ্রাং গ্রাম থেকে আসা ৪৫ বছর বয়সী ইয়াসমিন (ছদ্মনাম)। ১৯ দিন আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন স্বামীসহ ১১ সন্তান নিয়ে। প্রথমে তিনি ধর্ষিত হওয়ার বর্ণনা না দিতে চাইলেও স্বামীর অনুমতি নিয়ে জানান সেই ভয়ংকর মুহূর্তগুলোর কথা।
ইয়াসমিন বলেন, ‘গ্রামে ঢুকে সেনারা বলে তোমাদের কাছে অস্ত্র থাকলে আত্মসমর্পণ কর। যখন গ্রামবাসী বলে অস্ত্র নেই, সেনারা সবাইকে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করতে শুরু করে।’
‘আট সেনা আমার ঘরে ঢুকে এবং চার, ছয় ও আট বছর বয়সী সন্তানদের লাথি ও ছুরি মারতে থাকে। সন্তানদের বাইরে ফেলার পর বিভিন্ন বয়সী পাঁচজন সেনা আমাকে ধর্ষণ করতে থাকে। আর তিন সেনা বাইরে প্রহরা দেয়। ওই ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা আমি মুখে বলতে পারব না। তখন মনে হচ্ছিল, আমি মারা যাচ্ছি।’
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/সাদ