পাঁচ মাস লম্বা এক ‘ঘুমের পার্টি’। কলেজের ছাত্রাবাস। অন্তর্মুখী ধরনের মানুষের জন্য এক নরক। বিশ্বের সবচেয়ে শীতল ও রহস্যময় মহাদেশে জীবনযাপন কেমন তা জানতে চাইলে এভাবেই জবাব দিয়েছেন অ্যান্টার্কটিকার কয়েকজন বাসিন্দা।
১৯৫৯ সালে চিলি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশ ‘অ্যান্টার্কটিক চুক্তি’ স্বাক্ষর করেছিল। এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, পৃথিবীর সপ্তম মহাদেশটি শুধু ‘শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে’ ব্যবহার করা হবে। সে অনুযায়ী মহাদেশটিতে কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই। তবে সামরিক বিমান ও জাহাজ লোকজন ও রসদ সরবরাহ নিয়ে আসতে পারে।
একই কারণে মানুষের আনাগোনাও অ্যান্টার্কটিকায় নিতান্ত কম। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের নাগরিক মিলিয়ে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ অ্যান্টার্কটিকায় বাস করেছে। তাদের বড় অংশই বিজ্ঞানী ও গবেষক। অ্যান্টার্কটিকার ঘাঁটিগুলোতে অচেনা লোকদের সঙ্গে বাংক বিছানায় (কয়েকতলা বিছানা) থাকতে হয়।
প্রচণ্ড শীত ও পানি সাশ্রয়—দুই কারণে গোসল সারতে হয় ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে। ছোট ছোট কক্ষের মধ্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও শূন্যের কোঠায়। তার পরও এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মতো নির্ভীক ভ্রমণকারী বিরল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের অধিবাসী কেরি নেলসন তাঁদেরই একজন।
নেলসন প্রথম ‘শ্বেত মহাদেশে’ যান ২০০৭ সালে ম্যাকমার্ডো ঘাঁটিতে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। অ্যান্টার্কটিকার তিনটি মার্কিন আউটপোস্টের মধ্যে এটি একটি। এ পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকায় ১৬টি মৌসুম কাটিয়েছেন তিনি।
বড়দের ‘সামার ক্যাম্প’
সাধারণত পশ্চিমা দেশে স্কুলশিশুদের জন্য গরমের ছুটিতে বাইরে থেকে এটা-সেটা শিখতে সামার ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। অ্যান্টার্কটিকায় বাস করা অভিজ্ঞ লোকজন মজা করে সেখানে সময় কাটানোকে বলেন বড়দের সামার ক্যাম্প। ম্যাকমার্ডো বেইস এলাকায় গ্রীষ্মের সময় হচ্ছে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত। এ সময় সেখানে এক হাজারের মতো মানুষ থাকতে পারেন। তাঁদের মধ্যে পাওয়া যাবে বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে ছুতার এবং থালা-বাসন ধোয়ার লোক পর্যন্ত। অনেক সহকারীকেই একাধিক ধরনের কাজ করতে হয়; যেমন—অ্যান্টার্কটিকা পতাকার রূপকার ইভান টাউনসেন্ডকে রান্নাঘর, বার সামলানোর পাশাপাশি বেইসবাসীর যাঁর যাঁর শখের কাজকর্ম করার ‘ক্রাফট রুমের’ দেখাশোনা করতে হতো।
ম্যাকমার্ডো বেইস সম্পর্কে কেরি নেলসন বলেন, ‘এটা এক আস্ত শহর। কয়েকটা মৌসুম পুরো কাটালেও হয়তো খুব বেশি লোকের সঙ্গে দেখা হবে না আপনার। আর এই স্টেশনটা খুবই ব্যস্ত। সব সময় লোকজনের চলাফেরা আর গুঞ্জন।’
ম্যাকমার্ডো বেইসে কিছু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে; যেমন—ডিভিডি দেখার ঘর, ক্রাফট রুম, জিম। তা ছাড়া বেইসের ক্লাবহাউস ধরনের পরিবেশের কারণে সামাজিকীকরণের অনেক সুযোগই আছে। কেরি নেলসন তো এই চিরতুষারের রাজ্যেই ফ্যাশন শো আর গানের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছেন।
ম্যাকমার্ডো থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই নিউজিল্যান্ডের স্কট বেইস। কখনো কখনো সেখানকার কর্মীরা মার্কিন প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করতে রস দ্বীপ পাড়ি দিয়ে আসেন। চলে গানের আড্ডা, বুক ক্লাব মিটিং বা ছবি দেখার আসর। কিছু কর্মী এমনকি যোগব্যায়াম, ভাষা বা আগ্রহের অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন।
এই জীবন খুঁজছিলেন যিনি
ক্রিস লং নামের নিউজিল্যান্ডের বছর কুড়ি বয়সের এক তরুণ জানালেন, অ্যান্টার্কটিকায় এসেই নিজের পছন্দের দুটি বিষয়—হিপহপ নাচ আর থাই ম্যাসেজ শেখা হয়েছে তাঁর। নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করার দাবিদার লং ছন্নছাড়া ধরনের মানুষ। ঝোঁকের মাথায় অ্যান্টার্কটিকাগামী এক রুশ বরফ ভাঙার জাহাজের রান্নাঘরে চাকরি নিয়েছিলেন। দক্ষিণ মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে সেই জাহাজ হামেশাই ৪৫ ডিগ্রি কাত হয়ে চলত। চাকরিটা একেবারেই পছন্দ হতো না তাঁর। কিন্তু সেখানে থাকতে থাকতেই পেয়ে গেলেন অ্যান্টার্কটিকায় মনের মতো কাজ। এখন লং নিউজিল্যান্ডের স্কট বেইসের বিজ্ঞানীদের জন্য রসদ ব্যবস্থাপনার কাজ করেন। এ একেবারেই ভিন্ন ধরনের এক কর্মজীবন। ড্রেক প্যাসেজের কুখ্যাত উত্তাল জলরাশি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় যাতায়াতেই তাঁর বছরের অর্ধেকটা কেটে যায়।
কিন্তু ক্রিস লং হলফ করেই বলেন, এর চেয়ে ভালোভাবে কিভাবে থাকা যায় তা তাঁর মাথায় আসে না।
দুনিয়ার সর্বদক্ষিণের ডাকঘর
লরা বুলসবাখ কাজ করেছেন অ্যান্টার্কটিকার পোর্ট লক্রয়ের এক পোস্ট অফিসে। বলা হয়ে থাকে, সেটাই পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের ডাকঘর। বুলসবাখসহ ছয়জন কর্মী ছিলেন গুডিয়ের আইল্যান্ডে অবস্থিত ব্রিটিশ সরকারের অধীন ওই স্থাপনায়। পুরো দ্বীপটি একটি ফুটবল মাঠের সমান। একটা কুঁড়ের মতো ঘরে ছিল সাকল্যে দুটি কক্ষ। সেখানেই গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে ছয়জনকে। সেই ঘরে ছিল না ট্যাপের পানির ব্যবস্থা। কাজেই যথাযথভাবে গোসল বা ফ্লাশ করার উপযোগী টয়লেটেরও ভালো ব্যবস্থা থাকার প্রশ্ন আসে না।
লরা বুলসবাখ বললেন, সবার মধ্যেই একটা কমন ভুল ধারণা আছে যে অ্যান্টার্কটিকার জীবন একঘেয়ে ধরনের। কিন্তু তাঁর মতে, গুডিয়ের আইল্যান্ডের পোর্ট লক্রয়ের মতো ছোট জায়গায়ও দিনভর কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো তাঁদের। একঘেয়ে বোধ করার সুযোগই ছিল না আসলে।