কক্সবাজারে নেই আশানুরূপ পর্যটক, সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে যাত্রী হয়রানি

করোনার সময়ের মতো হতাশা আবার শুরু হয়েছে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। পর্যটন মৌসুম নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত হলেও সবখানে এখন শূন্যতা। হাতে গোনা কিছু পর্যটকের উপস্থিতি আশানুরূপ ব্যবসা হচ্ছে না। ফলে লগ্নি ফিরে আসা নিয়ে চরম দুঃচিন্তায় রয়েছেন পর্যটনের ব্যবসায়ীরা। এর প্রধান কারণ হিসেবে পরিলক্ষিত হয়েছে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ সংকুচিত হওয়াসহ নানা কারণ। কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, সেপ্টেম্বরের শেষ সময় হতেই কাগজে-কলমে পর্যটন মৌসুম।

কক্সবাজারে নেই আশানুরূপ পর্যটক, সেন্টমার্টিনগামী জাহাজে যাত্রী হয়রানি

নভেম্বরের শেষ আর ডিসেম্বরের শুরুতে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে ভ্রমণপিপাসু পরিবারগুলো কক্সবাজারে আসেন- সেনটমার্টিন ভ্রমণে যান। কর্পোরেট অফিসগুলোর অনেকে বার্ষিক কনফারেন্সগুলো কক্সবাজারেই করে। এখন মৌসুমের মাঝামাঝি সময় চললেও পর্যটক খরা চলছে বলা যায়। বিগত সময়ে বিজয় দিবস উপলক্ষে পর্যটকে টইটম্বুর হতো কক্সবাজারে। অনেক পর্যটক হোটেলে রুম না পেয়ে সড়কের কিনারে, বালিয়াড়ি, গাড়িতে রাত কাটানোর চিত্রও অতীতে সবাই দেখেছে- কিন্তু শুক্রবার বিজয় দিবস এবং শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকলেও হাতেগোনা পর্যটকই এবার কক্সবাজারে এসেছে। ১৫-২০ পার্সেন্ট রুমই বুকিং ছিল এবার। পর্যটক সেবাই প্রস্তুতি থাকলেও বালিয়াড়িসহ কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলো অনেকটা নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। এতে ধার-দেনায় লগ্নিকরা ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন সময় পার করছেন।

এদিকে কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন তিনটি জাহাজ পরিচালনা করছে একটি গ্রুপ। সেই জাহাজে মনগড়া সিদ্ধান্তে পর্যটকদের আসা-যাওয়া নিয়ে করছে যা ইচ্ছে তা। কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী নামক জাহাজ অনুমতি থাকলেও এখন বারো আউলিয়া ও চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়া বে-ওয়ান জাহাজ কক্সবাজারে পর্যটক উঠানামা নিয়ে ভয়ংকর প্রতারণা করছে। কয়েকদিন আগে সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়ে আসা কর্ণফুলী জাহাজ বাঁকখালীর মোহনায় ইন্জিন নষ্ট হয়ে গেলে কোনরকম রাত ১২টার দিকে অনেক চেষ্টার পর নুনিয়াছড়াস্থ ঘাটে ভিড়ে। এরপর দিন বারো আউলিয়া ও বে-ওয়ান জাহাজ নিয়ে কক্সবাজার থেকে পর্যটক টানে। সেখানে বাঁধে বিপত্তি। কক্সবাজার থেকে সকাল ৭টায় ছেড়ে যাওয়া জাহাজ সেন্টমার্টিন পৌঁছে সন্ধ্যা ৬টায়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয় অনেক পর্যটক।

গত শনিবার সেন্টমার্টিন থেকে তিনটি জাহাজের যাত্রী বে-ওয়ান নিয়ে কক্সবাজার ছেড়ে আসে। এতেও অতিরিক্ত যাত্রী হওয়ায় জাহাজে কর্তৃপক্ষের স্টাফদের সাথে পর্যটকদের হাতাহাতি হয়। জাহাজে থাকা পর্যটক অভি মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, গতকাল সেন্টমার্টিন থেকে আসার সময় কর্ণফুলী এক্সপ্রেস নষ্ট হয়ে যায় তারপর এমভি বারো আউলিয়াতে জোড় করে সব যাত্রী তুলে দেওয়া হয় তাতে করে বেশির ভাগ যাত্রী দাঁড়িয়ে আসতে হয়। আর জাহাজ ছাড়ার কথা ছিল বিকাল সাড়ে ৩টা সেটা কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বিকাল ৫:১০ মিনিটে সেন্টমার্টিন ঘাট থেকে ছাড়ে। আর জাহাজ কক্সবাজার ঘাটে এসে পৌঁছায় রাত ১২:১০ এ তাতে করে প্রায় ১৫০-২০০ জন এর বেশি যাত্রীরা তাদের বাস মিস করেছে। আমাদেরও বাস সাড়ে ১০টায় ছিল আমাদেরও মিস হয়েছে। কিন্তু ধন্যবাদ গ্রীন লাইন পরিবহনকে কারণ যারা আমরা বাস মিস করেছি তাদের জন্য ২টা বাস গ্রীন লাইন ম্যানেজ করে দিয়েছে রাত দেড়টায়। জাহাজের সার্ভিস একদমই ফালতু ১০ এর মধ্যে ১ ও দেওয়া যাবে না ওদের সার্ভিসকে

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, তিন জাহাজের যাত্রী এক জাহাজে নিয়ে আসছে সেন্টমার্টিন থেকে, অথচ চট্টগ্রাম থেকে আসা বে-ওয়ান জাহাজ যাত্রীদের টিকেট কেটেছে সেন্টমার্টিন টু চট্টগ্রাম। এখন রাতে কক্সবাজারে নামিয়ে লক্করঝক্কর গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবে মৃত্যুকূপে ধাবিত হচ্ছে হয়তো বড় ধরনের বিপদ হলে প্রশাসন বলবে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।

হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে সৈকতের বালিয়াড়িতে লোকজনের ভিড় বাড়ে। এবার ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং সাপ্তাহিক ছুটি একইদিন পড়েছে। এতেও আগের মতোই লোকসমাগম হয়েছে। বালিয়াড়িতে ভিড় বাড়লেও সকলেই পর্যটক নন। এখানে সৈকত দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি, যারা কক্সবাজার শহর কিংবা আশপাশের এলাকা হতে আসেন আর সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে যান। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ও কক্সবাজারের স্থল উপজেলার লোকজন কক্সবাজারে দিনে এসে দিনেই ফিরে যান।

ট্যুরস অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, কক্সবাজার বেড়াতে আসা পর্যটকদের ৭০ শতাংশ সেন্টমার্টিনের নৈঃস্বর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে যান। সেই হিসেবে গত কয়েক দশক ধরে প্রবাল দ্বীপকে ঘিরেই কক্সবাজারের পর্যটন। কিন্তু চলতি মৌসুমে অদৃশ্য কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সেটা জেনেই কক্সবাজারে পর্যটক আসা কমেছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন জাহাজ চলাচল শুরু না হলে মৌসুমের বাকি সময়ও একইভাবে মন্দা যাবে এতে সন্দেহ নেই।

সী-ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, প্রতিবছর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে ১০টি পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করে। কিন্তু এবার কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলি জাহাজটি ছাড়া টেকনাফ থেকে কোনো জাহাজ চলাচল করছে না। কর্ণফুলি জাহাজে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ ব্যয়বহুল। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পর্যটকরা এটাতে ভ্রমণ করতে পারেন না। এছাড়া কর্ণফুলী জাহাজের ধারণ ক্ষমতাও কম। তাই মধ্য ও নিম্নবিত্ত পর্যটকের কক্সবাজার ভ্রমণে আসা বিগত সময়ের চেয়ে কমেছে। টেকনাফে বর্তমান ঘাট থেকে সমস্যা হলে সাবরাংয়ের জেটি দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু করা যায়। সেখান হতে জাহাজগুলো সেন্টমার্টিন ঘাটে পৌঁছানো অধিকতর সহজ- ভাড়াও বাড়বে না সময়ও কম লাগবে।

সেন্টমার্টির দ্বীপের হোটেল সি প্রবালের পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, সেন্টমার্টিনের প্রায় ১০ হাজার মানুষের ৯০ শতাংশই পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। বাকি ১০ শতাংশ মানুষের রুটিরুজি নির্ভর করে সাগরে মাছ ধরায় ৷ আর পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত ৯০ শতাংশ মানুষের আয় হয় মাত্র ৪ মাস। বাকি সময়গুলো ৪ মাসের আয় দিয়ে অতিবাহিত করে। কিন্তু ভরা মৌসুমেও দ্বীপে আশানুরূপ পর্যটক যেতে না পারায় আমাদের লগ্নি উঠে আসবে বলে মনে হয় না। তাই বাকি সময়ের জন্য হলেও টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিতে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

কক্সবাজারের তারকামানের হোটেল কক্স-টুডের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আবু তালেব বলেন, সারা বছরই কক্সবাজারে পর্যটন জমানো সম্ভব। কিন্তু সেভাবে সুযোগ-সুবিধা গড়ে না উঠায় পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে আবাসন ও খাবার প্রতিষ্ঠান এবং অন্য ব্যবসাগুলো সাজিয়ে প্রস্তুত করা হয়। অর্ধসহস্রাধিক হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ ভরমৌসুমেও পর্যটক না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। আমাদের শত কোটি টাকা ঋণ চলমান, ব্যবসা না পেলে ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খেতে হয়। কমবেশি সবাই এ সমস্যায় পতিত হন। এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরনের লোকসানের শঙ্কা রয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প। এর প্রসারে সরকার করণীয় সবকিছুই করছে। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ নাব্য সংকটজনিত কারণে। বিকল্প প্রস্তাবণা নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন মহলে লিখেছি। এখানে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা আছে। আমাদের পাঠানো চিঠির বিষয়ে নির্দেশনা এলে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।