বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতে তোলপাড় সৃষ্টি করা ‘ডিপসিক’ কী?

চীনের তৈরি স্বল্পব্যয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেলের উত্থান নিয়ে উদ্বেগে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতে তোলপাড় চলছে। এর প্রভাবে ধস নেমেছে এ খাতের শেয়ারবাজারেও। যা চিন্তায় ফেলছে এনভিডিয়া, চ্যাটজিপিটিকেও। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও।

মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

এতে বলা হয়, গত সপ্তাহে চীনা স্টার্টআপ ডিপসিক একটি ফ্রি এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট উন্মোচন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রচলিত এআই পরিষেবাগুলোর তুলনায় কম ডাটা ও খরচে অধিক কার্যকর হবে ডিপসিক। এই এআই অ্যাসিস্ট্যান্টটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং সোমবারের (২৭ জানুয়ারি) মধ্যে এটি অ্যাপল অ্যাপ স্টোর থেকে ডাউনলোডের সংখ্যায় মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যাটজিপিটিকেও পেছনে ফেলেছে।

চীনের এই নতুন এআই মডেলের উত্থান এআই খাতের বর্তমান নেতাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এর ফলে প্রযুক্তি খাতে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা তীব্র আকার ধারণ করেছে।

ডিপসিকের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি খাতের শেয়ার বাজারে বড় ধস নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে এনভিডিয়ার বাজারমূল্য থেকে প্রায় ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গেছে, যা ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসে কোনো কোম্পানির জন্য একদিনে সর্বোচ্চ ক্ষতির রেকর্ড।

সোমবার এআই প্রযুক্তি খাতের ধসের প্রভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর নাসডাক সূচক ৩ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে। নাসডাকে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছে এনভিডিয়ায়, যার শেয়ারের দাম প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে এবং ওয়াল স্ট্রিটে একদিনে বাজারমূল্যে রেকর্ড ক্ষতির নজির স্থাপন করেছে। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ গ্রুপের (এলএসইজি) তথ্য অনুযায়ী, সোমবার এনভিডিয়ার বাজারমূল্যের ক্ষতি ছিল পূর্বের রেকর্ডের দ্বিগুণেরও বেশি।

নাসডাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রভাব ফেলেছে চিপ নির্মাতা ব্রডকম ইনকরপোরেটেড, যার শেয়ারের দাম ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে। এর পরেই রয়েছে চ্যাটজিপিটির সহযোগী মাইক্রোসফট, যার শেয়ার ২ দশমিক ১ শতাংশ পড়ে গেছে, এবং গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট, যার শেয়ার মূল্য ৪ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা স্টার্টআপ ডিপসিকের নতুন কম খরচের এআই অ্যাসিস্ট্যান্টের জনপ্রিয়তা এবং এর প্রভাব প্রযুক্তি খাতে বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে, যা নাসডাক সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

সোমবার ফিলাডেলফিয়া সেমিকন্ডাক্টর ইনডেক্স ৯ দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর একদিনের সবচেয়ে বড় পতন। ইনডেক্সের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত ছিল মার্ভেল টেকনোলজি, যার শেয়ার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ নিম্নমুখী হয়েছে।

মার্কিন বাজারে এই পতন এশিয়া থেকে শুরু হওয়া শেয়ার বিক্রির ধারাবাহিকতার অংশ। জাপানের সফটব্যাংক গ্রুপ ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নিচে নেমে গেছে, যখন ইউরোপের বাজারেও পতনের ধাক্কা লেগেছে। ডাচ চিপ নির্মাতা এএসএমএল ৭ শতাংশ শেয়ার হারিয়েছে।

অ্যানেক্স ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ ব্রায়ান জ্যাকবসেন বলেন, ‘যদি সত্যি ডিপসিক একটি ‘উন্নত পদ্ধতির ফাঁদ’ হয়, তবে এটি গত দুই বছর ধরে বাজার চালিয়ে আসা এআই-কেন্দ্রিক অবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা নতুন এআই মডেলের সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করছেন, যা এআই শিল্প এবং তার বাজারের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।’

চীনা স্টার্টআপ ডিপসিকের কম খরচের এআই মডেল প্রযুক্তি খাতের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে, যা চিপ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বৃহৎ ডেটা সেন্টার নির্মাণের চাহিদা হ্রাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তিনি বলেন, ‘চীনা এআই মডেল ডিপসিক বাজারে যে ঝড় তুলেছে, সেটা আমাদের শিল্প মহলের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে। প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য আমাদের চূড়ান্ত মনোনিবেশ করতে হবে।’

তবে এটিকে ইতিবাচক উল্লেখ করে ট্রাম্প আরও বলেন, ডিপসিকের প্রভাবে যে তোলপাড় তৈরি হয়েছে, সেটা ইতিবাচক হতে পারে। কারণ এতে আরও কম দামে নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি নিয়ে আসতে বাধ্য হবে মার্কিন সংস্থাগুলো।

ডিপসিক কী?

ডিপসিক একটি চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোম্পানি। এর সদর দপ্তর দক্ষিণ-পূর্ব চীনের হাংঝৌ শহরে। কোম্পানিটি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের জনপ্রিয় এআই অ্যাপটি যুক্তরাষ্ট্রে ১০ জানুয়ারি মুক্তি পায়। ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং।

লিয়াং ওয়েনফেং মূলত হেজ ফান্ডের মাধ্যমে ডিপসিকের আংশিক অর্থায়ন করেন। ৪০ বছর বয়সী এই ইনফরমেশন অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারের স্নাতক এনভিডিয়ার এ-১০০ চিপের একটি বিশাল মজুত সংগ্রহ করেছিলেন। তবে এই চিপ এখন চীনে রপ্তানি নিষিদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আনুমানিক ৫০ হাজার চিপের মালিক হয়েছিলেন ওয়েনফেং। এই চিপগুলোর সঙ্গে সস্তা চিপ মিলিয়ে ব্যবহার করেই তিনি ডিপসিক প্রতিষ্ঠা করেন।

ডিপসিক তাদের এআই অ্যাপটি অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোডের জন্য উন্মুক্ত করে। গ্রাহকেরা বিনা মূল্যে এই অ্যাপটি ডাউনলোড করতে পারবেন। উন্মুক্ত করার পর দ্রুতই এটি অ্যাপলের স্টোরে সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া অ্যাপে পরিণত হয়। তবে, সাইন আপ করতে কিছু ব্যবহারকারী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানা গেছে।

ডিপসিকের শক্তিশালী এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট চ্যাটজিপিটির মতোই কাজ করে এবং এটিই এর জনপ্রিয়তার কারণ। অ্যাপ স্টোরের বিবরণ অনুযায়ী, ‘এটি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং জীবনকে আরও কার্যকরভাবে সহজ করতে’ ডিজাইন করা হয়েছে।