বৈদ্যুতিক গাড়ির নেতৃত্ব যাচ্ছে চীনের হাতে

পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীন গত জুলাই মাসে নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ওই মাসে দেশটিতে যত তেলচালিত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ি। চীনের বাজারে এসব গাড়ি নতুন জ্বালানির গাড়ি হিসেবে পরিচিত।

চীনের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জুলাই মাসে দেশটির বাজারে যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার ৫১ শতাংশই ছিল বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ি। অথচ ২০২১ সালের একই সময়ে দেশটির বাজারে এ ধরনের গাড়ি বিক্রি হয়েছিল মোট গাড়ির মাত্র ৭ শতাংশ। এখানেই শেষ নয়, আগস্ট মাসেও দেশটির বাজারে এই নতুন জ্বালানিভিত্তিক গাড়ি বিক্রিতে চাঙাভাব বজায় ছিল। চলতি বছরে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি কমেছে। তারা চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি ঠেকাতে চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে চীনা গাড়ি আমদানি নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র।

মানি উইকের খবরে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসের তুলনায় এ বছরের জুলাই মাসে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৮ লাখ ৭৮ হাজারে উন্নীত হয়েছে। একই সময়ে প্রথাগত গাড়ি বিক্রি কমেছে ২৬ শতাংশ। বিক্রি হওয়া এ ধরনের গাড়ির মোট সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৪০ হাজার।

যুক্তরাষ্ট্রে বছরের প্রথম প্রান্তিকে যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার মাত্র ১৮ শতাংশ ছিল বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড; অর্থাৎ বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যানুসারে, চলতি বছর চীনের বাজারে ১ কোটি ১০ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হবে। অথচ ইউরোপে বিক্রি হবে মাত্র ৩৪ লাখ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ লাখ। এর বাইরে বিশ্বের অন্যান্য বাজারে আরও ১৫ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হতে পারে।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির আরও পূর্বাভাস, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির পরিমাণ দুই কোটিতে উন্নীত হবে।

বৈশ্বিক বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে চীন এমনিতেই এগিয়ে; সম্প্রতি চীনে এই বাজারের ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ বছর যদি চীনের বাজারে ১ কোটি ১০ লাখ গাড়ি বিক্রি হয়, তাহলে তা হবে ২০২১ সালের তুলনায় তিন গুণ। ওই বছর চীনে মাত্র ১৩ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছিল। চীনে এই গাড়ির বাজারে এতটা বিকশিত হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, উৎপাদক ও ভোক্তাদের প্রণোদনা দেওয়া, মূলত ভর্তুকি ও করছাড়। সেই সঙ্গে এই প্রযুক্তি ও শিল্পের অবকাঠামোতে কৌশলগত বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এ কারণে বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম প্রথাগত গাড়ির তুলনায় কমে গেছে। টেসলার সবচেয়ে কম দামি গাড়ির তুলনায় চীনের বিওয়াইডির বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম অর্ধেকের কম।

বৈদ্যুতিক গাড়ির বিপণনে চীনে যে আখ্যান তৈরি করা হয়েছে, সেখানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিষয়টি কালেভদ্রে উল্লেখ করা হয়। মূল বিষয় হলো, চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি দামে সস্তা হওয়ার কারণে বাজারে বাজিমাত করছে। আটপৌরে দৈনন্দিন গাড়ি থেকে শুরু করে বিলাসবহুল স্পোর্টস কার, হাইব্রিড এসইউভি ও উন্নত প্রযুক্তির গাড়ি—সব শ্রেণির চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম মার্কিন ও ইউরোপীয় গাড়ির চেয়ে কম। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তিংলং ডাই মানি উইককে বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে চীন নেতৃত্ব দিচ্ছে। চীনের গাড়ির মান যেমন ভালো, তেমনি দাম কম এবং বৈচিত্র্যেও তুলনাহীন।

বিশ্লেষকেরা বলেন, চীন বিশ্বের কোনো একটি শিল্প খাতে এককভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পশ্চিমারা যে পরিবেশ রক্ষার কথা বলে, সেই ধারণার সঙ্গেও এই শিল্প সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরিবেশগত বিষয় যে একেবারে চীনের বিবেচনায় নেই, তা নয়। তবে সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ও আছে। কিন্তু মূল কথা হলো, চীনের কাছে এটি একটি ভূরাজনীতিগত বিষয়। এ খাতে কর্তৃত্ব করার মধ্য দিয়ে চীন বড় এক শিল্পে কর্তৃত্ব করার সুযোগ পেতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে তার বৈশ্বিক নেতৃত্বের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।

নিজের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে চীন বিশ্ববাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি রপ্তানি করছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের গাড়ি রপ্তানি বেশি করছে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির স্থানীয় সরবরাহ ব্যবস্থা ও উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করেছে চীন। গাড়ির শক্তির উৎস ব্যাটারি ও অন্যান্য কাঁচামাল প্রাপ্তিতে জোর দিচ্ছে তারা।

বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের এখন সবচেয়ে বড় বাধা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। উভয় অঞ্চল নিজেদের উৎপাদিত বৈদ্যুতিক গাড়ির সুরক্ষা দিতে চীনের গাড়িতে শুল্কহার বৃদ্ধি করেছে। তাদের অভিযোগ, চীন এই বাজারের রাশ নিজের হাতে রাখতে অন্যায্যভাবে নানা প্রণোদনা দিচ্ছে। চীনের তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়িতে যুক্তরাষ্ট্র একসময় ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করত। সম্প্রতি সেই শুল্ক ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। স্পষ্টত, চীনের গাড়িশিল্পকে পঙ্গু করে দিতেই তাদের এই শুল্ক বৃদ্ধির পদক্ষেপ। চীনে তৈরি লিথিয়াম ব্যাটারিতে শুল্কহার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া এই শিল্পে প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদানের ওপর শুল্ক শূন্য শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ এবং সৌর প্যানেলে শুল্ক ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ ও সেমিকন্ডাক্টরে শুল্ক ২৫ থেকে ৫০ শতাংশে বাড়ানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপের বাজারে চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি বেশি বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে ইউরাপীয় কিছু কোম্পানি চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন করছে, যে গাড়ি ইউরোপের বাজারে আনা হচ্ছে। কিন্তু ইউরোপও যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়িতে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করেছে। এর আগে গত বছর ১ হাজার কোটি ইউরোর বেশি মূল্যের চীনে তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে।

ইউরোপে এখন চীনা বৈদ্যুতিক গাড়িতে সর্বোচ্চ ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কোন কোম্পানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন কতটা মান্য করছে, তার ওপর নির্ভর করবে এই শুল্ক। আগে সোজাসাপ্টা ১০ শতাংশ শুল্ক ছিল ইউরোপের বাজারে। এখন অতিরিক্ত ১৭ থেকে ৩৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে চীনা বৈদ্যুতিক গাড়িকে।

তবে এই বৈদ্যুতিক গাড়িশিল্পে বাজিমাত করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে উভয়সংকটে ফেলে দিয়েছে চীন। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র জোর গলায় পরিবেশ রক্ষার কথা বলছে, কিন্তু একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক গাড়িতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করছে। ফলে তাদের এ কথার গুরুত্ব থাকছে না। এসবই তারা করছে ভূরাজনীতির স্বার্থে। মূল কথা হলো, যেকোনো মূল্যে চীনের উত্থান ঠেকাতে হবে। এই নীতির কারণে পশ্চিমাদের স্ববিরোধিতা আরও পরিষ্কার হচ্ছে।

Scroll to Top