এতদিন ধরে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এনে ওই অর্থ গ্রাহকের মনোনীত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিত। আর এর মাধ্যমে টাকা হাতে পেতে গ্রাহকের অনেক সময় লাগত। তাছাড়া হতে হতো নানা হয়রানিও। তবে এখন পরিত্রাণ আসছে সেই পরিস্থিতি থেকে। এখন থেকে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি রেমিট্যান্স আনতে পারবে। আর গ্রাহকও রেমিট্যান্সের টাকা দ্রুত হাতে পাবেন।
মূলত, বিকাশ, রকেট ও উপায়ের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সরাসরি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আনার সুযোগ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করেছে। সার্কুলারের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স প্রাপ্ত এমএফএস প্রতিষ্ঠানে এ সেবা পাবেন প্রবাসীরা। এতে তাৎক্ষণিকভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালার আওতায় বিকাশ ও রকেটের মতো মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডাররা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসনের সুযোগ পাবে, যা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসন বা হুন্ডি বন্ধ করতে সহায়তা করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সেই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডাররা প্রবাসী আয় প্রত্যাবাসনের জন্য (দেশে আনার জন্য) বিদেশস্থ অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার, ব্যাংক, ডিজিটাল ওয়ালেট, কার্ড স্কিম ও এগ্রিগেটর পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারবে। আগ্রহী মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আয় প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে অনুমোদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স এলো ৪৬ হাজার কোটি টাকা
সার্কুলারের ভাষ্য অনুযায়ী, বিদেশি প্রতিযোগীদের সঙ্গে স্থানীয় মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডারদের চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা জমা হবে, যা প্রবাসীর মোবাইল ফাইনান্সিয়াল হিসেবে টাকায় রূপান্তরিত হয়ে জমা হবে। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা যথাযথা ই-কেওয়াইসি পরিপালন করে মোবাইল ব্যাংকিং অর্থাৎ এমএফএস-এ হিসাব খুলতে পারবেন। এ দেশীয় ব্যাংক মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারদের সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট সুবিধা দেবে। ব্যাংকের বিদেশি নস্ট্রো হিসাবে অর্থ জমার পর ওই অর্থের সমপরিমাণ টাকা সেটেলমেন্ট হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) জমা হবে।
‘নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট’ হলো বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশের দায়-দেনা পরিশোধের জন্য বিদেশের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্ট। এই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে গ্রাহকের পক্ষে বিদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে সংশ্লিষ্ট পণ্য বিক্রেতার এলসি মূল্য পরিশোধ করা হয়। আবার রপ্তানি বিল ও রেমিট্যান্সের অর্থও নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে যোগ হয়।
তথ্যমতে, গেল বছরের জুলাই থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে শুরু করে। এখন এটি বেশ কমে গেছে। প্রতি মাসেই গড়ে রেমিট্যান্স কমছে। এ কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব ও দেশে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা করতে রিজার্ভ বাড়ানোর বিকল্প নেই। কেননা রপ্তানি আয় কমে গেছে। এখন রেমিট্যান্স বাড়াতে পারলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।
এমন পরিস্থিতিতে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধে চতুর্মুখী তৎপরতা শুরু করে সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও বাংলাদেশ সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এসব প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মাঠ পর্যায়ে, বিএফআইইউ ব্যাংকিং চ্যানেলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন হুন্ডিবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হুন্ডি বন্ধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতেই মূলত এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে রেমিট্যান্সে পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি বন্ধের নির্দেশ দেন। বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের হুন্ডির ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়। তারা বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডির তথ্য পান।
যেসব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে হুন্ডি হচ্ছে এমন ২ শতাধিক হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়। হুন্ডির সঙ্গে জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের লাইসেন্স বাতিল করারও প্রক্রিয়া শুরু হয়। যেসব হিসাব জব্দ করা হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে এখন বিশদ তদন্ত চলছে। বিএফআইইউ থেকে ইতোমধ্যে হুন্ডির বিষয়ে সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেওয়া হয়েছে। তারা এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করছে।