ই-কমার্সের নামে চলছে ভয়াবহ প্রতারণা

তরুণদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজনেস হচ্ছে ই-কমার্স। অনলাইনে পণ্য কেনাকাটায় ই-কমার্সের নামে চলছে ভয়াবহ প্রতারণা। এ প্রতারণা বন্ধে কার্যকর আইন করার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ইভ্যালির ৩৭ লাখ গ্রাহক এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ইভ্যালির কার্যক্রম খতিয়ে দেখছে। ইভ্যালির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আসার পরই হুমকিতে পড়েছে পুরো ই-কমার্স খাতটি।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ইভ্যালির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে। তা যদি সঠিক হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন রয়েছে। সে আইন অনুযায়ী পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ইভ্যালি গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে কিনা তা আমি বলতে পারব না। তবে প্রতারণা যে-ই করুক তার বিচার হতেই হবে।’ বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রধান আবু হেনা মো. রাজি হাসান বলেন, ‘আমরা ইভ্যালির সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছিলাম। সব ব্যাংককে তাদের অ্যাকাউন্টের তথ্য দিতে বলেছি।

ব্যাংকগুলো যে তথ্য দিয়েছে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ইভ্যালির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ পেয়েছি তা যাচাই-বাছাই করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ জানা গেছে, ইভ্যালির কার্যক্রম শুরুর দুই বছর পার না হতেই এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১ কোটি টাকা। ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক বছর আট মাস বয়সী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে নানা অভিযোগও জমা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়ের ধরন দেখে বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন, এতে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে।

অনলাইনে পণ্য কিনলে সময় বাঁচে, ঝক্কিও এড়ানো যায়। তাই ঘরের দুয়ারে প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নিবন্ধন নেয় ইভ্যালি। মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোন সেট, টেলিভিশন ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি গাড়ি বিক্রিতেও নেমেছে। কিন্তু শুরু থেকেই তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। নানাভাবে মানুষের আকর্ষণ জাগিয়ে বিপাকে ফেলেছে। সাধারণ ক্রেতার বেশির ভাগই সমস্যায় পড়েছে ইভ্যালির লেনদেনে। ইভ্যালির গ্রাহক ৩৭ লাখ ছাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। মাসে লেনদেন হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বিপরীতে কর দেওয়া হয়েছে দেড় কোটি টাকা। গড়ে প্রতি মাসে তারা পণ্য বিক্রির অর্ডার পাচ্ছে ১০ লাখ করে। তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়েছে ২৫ হাজার বিক্রেতা-প্রতিষ্ঠান এবং তারা ৪ হাজার ধরনের পণ্য বিক্রি করে কমিশন পাচ্ছে।

২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয় ইভ্যালি ডটকম লিমিটেড। এর অনুমোদিত মূলধন ৫ লাখ টাকা। ১০ টাকা মূল্যমানের ১ হাজার শেয়ারের মালিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল। আর ৪ হাজার শেয়ারের মালিক তার স্ত্রী কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ তমাল বলেন, ‘ইভ্যালির ব্যবসার মডেল যৌক্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি। ই-কমার্স নীতিমালা বদল ও ইভ্যালির সেবায় কোনো ফাঁকফোকর আছে কিনা তা তদন্ত করছি। আবার ইভ্যালির ব্যবসা এমএলএম কিনা তাও খতিয়ে দেখছি। ইভ্যালির ক্রেতা ও মার্চেন্টদের মতামতও নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ইভ্যালির ক্রেতারা যাতে প্রতারিত না হয়, সে উদ্যোগও নিচ্ছে ই-ক্যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘ই-কমার্সের নামে ভয়াবহ প্রতারণা বন্ধে আইন তৈরির জন্য আমরা কাজ করছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স নামে নীতিমালা করেছে। এখন আইনও দরকার।

অভিযোগের আলোকে ইভ্যালিকে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাজ করছে। আশা করছি, ই-ক্যাবের তদন্ত প্রতিবেদনও শিগগিরই প্রকাশ করতে পারব।’ জানা যায়, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইনের প্রচার ও প্রসার। ফলে প্রচলিত বিক্রয়ব্যবস্থার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে গ্রাহক পর্যায়ে সরাসরি পণ্য পৌঁছে দিতে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। আর এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ভুয়া অনলাইন পেজ খুলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু চক্র।

ইভ্যালির প্রতারণা : পণ্য কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক ক্যাশব্যাক অফার দিয়ে ব্যবসা করছে ইভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তারও বেশি অর্থ ফেরত দেওয়ার লোভনীয় এ অফারে হাজার হাজার গ্রাহক আকৃষ্ট হচ্ছে। লাভবানও হচ্ছে অল্প কেউ, বেশির ভাগই আছে লাভবান হওয়ার অপেক্ষায়। সাইক্লোন, থার্ন্ডাড স্ট্রং, ইথারকোয়াকসহ নানা ধরনের লোভনীয় অফার দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এসব অফারে দেওয়া হয়েছে বড় ধরনের মূল্যছাড়।

রিপন মিয়া নামে এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, গত ১৩ আগস্ট সাইক্লোন অফারে ২ হাজার ৬৫০ টাকার একটি প্রোডাক্ট তিনি অর্ডার করেছিলেন। ওই টাকার পরিবর্তে ১০ বারে ২৬ হাজার ৫০০ টাকা কেটেছে। এ নিয়ে তিনি রিপোর্টও ইস্যু করেন। কাস্টমার কেয়ারে অভিযোগও করেন। মেইলও করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলেছেন, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান হবে। কিন্তু প্রায় এক মাসেও তিনি ব্যালান্স ফেরত পাননি। ইভ্যালির সিস্টেম ভুলের কারণে টাকা কাটা হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এসব হয়রানি বন্ধ করতে হবে। হাসান বুলবুল নামে এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, তিনি ১২ জুন প্রোডাক্ট অর্ডার করেন। এখনো কোনো প্রোডাক্ট পাননি। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি আরও বলেন, টাকাপয়সা আগে নিয়েও কাস্টমারের পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে শীর্ষে যাওয়া যাবে না। মানুষের পকেট কেটে পয়সা বানানো যায়, কিন্তু শীর্ষে যাওয়া যায় না। আরেক ক্রেতা ২৪ জুন ইভ্যালি থেকে দুটি ফ্যান কেনার অর্ডার দিয়েছিলেন। দাম ৫ হাজার ৮০০ টাকা।

তিনি জানান, ইভ্যালি তাকে বলেছিল ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ফ্যান পৌঁছে দেবে বাসায়। অর্ডারের সঙ্গে ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার ২২০ টাকা ক্যাশব্যাক পান ওই ক্রেতা। এ টাকা ইভ্যালির সরবরাহ করা কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে শেষ করেন। কিন্তু প্রায় আড়াই মাস হতে চললেও ফ্যান আর পাননি তিনি। জানা যায়, ইভ্যালির রয়েছে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ‘ভাউচার অফার’। আছে ‘ক্যাম্পেইন’ নামক একটি বিকল্প কর্মসূচি।

ক্যাম্পেইনভেদে পণ্য সরবরাহ করা হয় ৭ থেকে ৪৫ দিনে। ইভ্যালি এও বলছে, অনিবার্য কারণবশত ক্যাম্পেইনে যে কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জনের সম্পূর্ণ অধিকার ইভ্যালি কর্তৃপক্ষের রয়েছে। গ্রাহকের অভিযোগ হচ্ছে, বেঁধে দেওয়া সময়ে তারা পণ্য পাচ্ছেন না।

এমন হাজারো অভিযোগ করেও কোনো সুফল পান না ক্রেতারা। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে ইভ্যালিও তাই করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। ই-কমার্সের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক পণ্য সময়মতো পৌঁছানো। কিন্তু ইভ্যালি অনেক ক্ষেত্রেই কাজটি করতে পারছে না। টাকা আটকে রেখে ইভ্যালি গ্রাহককে জানিয়ে দিচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ নেই (স্টক আউট) বলে অর্ডার বাতিল করা হলো। ‘গিফট কার্ড’ নাম দিয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে ইভ্যালি। এ প্রসঙ্গে বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, ‘প্রতিটি খাতেই ভালোমন্দ থাকে। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে হবে।

যারা পণ্য ফেরত না নেয়, তাদের কাছ থেকে কেনা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে।’ উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম বা উই সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, ‘যারা ই-কমার্সের নামে প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। জনস্বার্থ চিন্তা করতে হবে। ক্রেতাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। কারণ ই-কমার্স খাত অনেক বড় হয়েছে। দু-একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষতি করা যাবে না। ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে।’.
:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Scroll to Top