এত দিনে করোনাভাইরাস সম্পর্কে যা জেনেছেন বিজ্ঞানীরা

দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব যখন করোনা মহামারির কবলে পড়ে ধুঁকছে, বিজ্ঞানীরাই তখন আশার আলো দেখাচ্ছেন। তাঁদের সাফল্যের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে আমরা যা জানি, তার সবকিছুই গবেষণা করে দেখছেন তাঁরা। নতুন এ করোনাভাইরাসের উৎপত্তির ৫ মাস পার হয়ে গেল। কতটুকু জানতে পারলেন তারা? তাঁরা যতটুকু জানতে পেরেছেন, তা এ মহামারি ঠেকাতে যথেষ্ট তো? ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এসব প্রশ্নের উত্তর তুলে ধরা হয়েছে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন করোনাভাইরাস মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সার্স ও মার্স ভাইরাসও এই গোত্রের ছিল। সার্স ও মার্স—এ দুটি ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। তবে তাদের প্রভাব মহামারি সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯–এর তুলনায় অনেক কম ছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ভাইরাসটি। জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় মোট মারা গেছেন ১ লাখ ১৪ হাজার ১৮৫ জন। আর এখন পর্যন্ত শনাক্তের সংখ্যা ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫০৩ জন। এ ভাইরাস এখনো বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে।

লিপিড নামক ফ্যাটের রাসায়নিকের প্রলেপযুক্ত জেনেটিক উপাদানের এ চিটচিটে বল করোনাভাইরেসের জন্য অসাধারণ অর্জন। এই অতি ক্ষুদ্র আক্রমণকারী ভাইরাস মানুষের সক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও উল্লেখ করার মতো। মাত্র ৫ মাস আগেও এই ভাইরাসটি সম্পর্কে কোনো তথ্য বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল না। আজ এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। ভ্যাকসিন প্রকল্প বেড়েছে, ভাইরাস রোধী ওষুধের পরীক্ষা চালু করা হয়েছে এবং নতুন নতুন শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া হাজির হচ্ছে। কিন্তু সোজাসাপ্টা প্রশ্নটা হচ্ছে—গত ৫ মাসে আমরা কী শিখলাম এবং তা কীভাবে এ মহামারি মোকাবিলায় কাজে লাগানো যাবে?

কোথা থেকে এল?
প্রথমেই আমরা জেনে নিতে পারি ভয়ংকর ভাইরাসটি কোথা থেকে এল। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি বাদুড়ের উৎস থেকে উদ্ভূত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে ভাইরাসের ক্ষমতাকে তুমুল লড়াই উপযোগী করে তুলেছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাসকে দ্রুত প্রতিলিপি বা ক্লোন তৈরিতে সাহায্য করে, যা বাদুড়ের রোগ প্রতিরোধী সক্ষমতাকে হারিয়ে দেয়। এর ফলে বাদুড় দ্রুত পুনরুৎপাদন এবং অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য ভাইরাসের উৎসে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই বাদুড় যখন অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংস্পর্শে আসে এবং যাদের দ্রুত প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না, তখন তাদের আশ্রয় ধরে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে ভাইরাসটি মানুষের দেহে সংক্রমণের আগে মধ্যস্থ কোনো প্রজাতি যেমন, প্যাঙ্গোলিনের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক এডওয়ার্ড হোমস বলেছেন, ‘ভাইরাসটি সম্ভবত বাদুড় থেকে অন্য প্রাণীর মধ্যে এসেছিল এবং অন্য প্রাণীটি সম্ভবত মানুষের কাছেই ছিল, সম্ভবত বাজারে ছিল। যদি কোনো বন্য প্রাণী বাদুড় থেকে ভাইরাস পেয়ে থাকে এবং সে প্রাণী যিনি নাড়াচাড়া করছেন, তিনি সংক্রমিত হবেন। তিনি বাড়ি গেলে অন্যদের সংক্রমিত করবেন। এভাবেই মহামারি ছড়িয়ে পড়ে।’

সার্স-কোভ-২–এর সংক্রমণের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটতে পারে। যখন সংক্রমিত কোনো ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে ড্রপলেট বাইরে আসে তখন অন্যরা সংক্রমিত হয়।

ভাইরাসটি কীভাবে মানুষকে সংক্রমিত করে?
যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, শ্বাস নেওয়ার সময় ভাইরাসবাহিত কণাগুলো শ্বাসতন্ত্রে ঢুকে যায় এবং গলা ও গলনালির কোষের আস্তরণের সংস্পর্শে আসে। এসব কোষের পৃষ্ঠে প্রচুর ‘এইস-২ রেসেপ্টর’ নামে বিশেষ সংকেত গ্রহণকারী অংশ থাকে। কোষের রেসেপ্টর মূলত রাসায়নিক পরিবহনের মূল ভূমিকা রাখে এবং কোষের মধ্যে সংকেত প্রবাহের কাজ করে। ভাইরাসটিতে থাকা প্রোটিন ওই রেসেপ্টরে আটকে যায় এবং কোষের মধ্যে আরএনএ ঢুকে পড়ে। একবার কোষের ভেতর ঢুকে গেলে কোষের নিজস্ব প্রতিলিপি পদ্ধতিতে এটি নিজেকে যুক্ত করে নেয় এবং ভাইরাসের একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করে। এটি কোষ থেকে ফেটে বেরিয়ে যায় এবং সংক্রমণ বিস্তার লাভ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তা ওই ভাইরাসটিকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায় এবং এর অগ্রগতি রুখে দেয়।

বিশেষজ্ঞ জোনাথন বল বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ সাধারণত মৃদু হয়। এটাই এই ভাইরাসের সাফল্যের গোপন কারণ। অনেক মানুষ সংক্রমণের বিষয়টি ধরতেও পারে না। তাই তারা বাইরে যায় এবং ঘরের ভেতর অন্যদের সংক্রমণ ছড়ায়। অন্যদিকে সার্স করোনাভাইরাস রোগীকে দ্রুত অসুস্থ করে ফেলে এবং ১০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয় যাতে অন্যদের সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যায়। মৃদু কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এ বিষয়টি ধরা যায় না।’

কেন কোভিড-১৯ এ মৃত্যু ঘটছে?
করোনাভাইরাস মৃদু হলেও অনেক সময় এটি নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। করোনাভাইরাস যখন শ্বাসনালি ছেড়ে নেমে যায় এবং ফুসফুসে সংক্রমিত হয় তখন আসল জটিলতা সৃষ্টি হয়। কারণ ফুসফুসে আরও বেশি ‘এইস-২ রেসেপ্টর’ থাকে। ফুসফুসের অনেক কোষ ধ্বংস হয়ে যায়। এতে ভাঙা কোষে ফুসফুস ভরে যেতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে বা ইনটেনসিভ কেয়ার (আইসিইউ) নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক প্রতিরোধী কোষ ভাইরাসকে আক্রমণের জন্য ছুটতে থাকে যাকে ‘সাইটোকিন স্ট্রম’ বলে। গ্রিক ভাষায় সাইটো অর্থ কোষ আর কিনো অর্থ নড়াচড়া করা। অনেক ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ‘সাইটোকিন স্ট্রম’ ঘটনাটি দেখা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ঘটে না। কিন্তু এটি কেন ঘটে না, তা এখনো অজানা। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে ‘এইস-২’ রেসেপ্টরের ভিন্নতা। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে রেসেপ্টর বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।

সুস্থ রোগী কি আজীবনের জন্য সুরক্ষিত?
করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের পরীক্ষা করছেন চিকিৎসকেরা। তাদের শরীরের করোনাভাইরাসকে ঠেকানোর মতো যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখছেন তাঁরা। শরীরের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা এ অ্যান্টিবডি তৈরি করে। সংক্রমণকারী ভাইরাসকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আবরণে আটকে দিয়ে কোষ ভাঙার সক্ষমতা কমিয়ে দেয় অ্যান্টিবডি।

ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের ভাইরোলজিস্ট মাইক স্কিনার বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে, সংক্রমিত ব্যক্তির মধ্যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়াগুলো বেড়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা ভবিষ্যৎ সংক্রমণের ক্ষেত্রে সুরক্ষা দিতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এ সুরক্ষা আজীবনের জন্য নয়।’ অধিকাংশ ভাইরোলজিস্ট মনে করেন, কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ব্যবস্থা এক থেকে দুই বছর কার্যকর থাকতে পারে। স্কিনারের মতে, মানুষের মধ্যে সংক্রমণ বিস্তারকারী অন্য করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে একই বিষয় লক্ষ্য করা যায়। তাই এ রোগ মৌসুমি রোগ হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।

\"corona\"

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাইরাসটি আমাদের সঙ্গে কিছুদিন থাকবে। তবে, এর সক্ষমতা কি কমে যাবে? কিছু গবেষক বলছেন, করোনাভাইরাস এতো মারাত্মক রূপে হয়তো থাকবে না। তবে আরেক দল গবেষক যুক্তি দিচ্ছেন, ভাইরাসের আরও বেশি মিউটেশন ঘটবে এবং আরও বেশি বিষাক্ত হয়ে উঠবে। স্কিনার অবশ্য সন্দিহান। তিনি বলেন, ‘ভাইরাসের জায়গা থেকে এ মহামারিটিকে দেখতে হবে। বিশ্বজুড়ে খুব ভালোভাবে এটি ছড়াচ্ছে। এটি পরিবর্তন হলে সুবিধা করতে পারবে না। পরিশেষে, একটি কার্যকর ভ্যাকসিনের উন্নয়ন বিশ্বকে কোভিড-১৯ এর হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে।

কবে আসবে ভ্যাকসিন?
গত শুক্রবার পর্যন্ত ‘নেচার’ সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৭৮টি ভ্যাকসিন প্রকল্প চালু করা হয়েছে যার মধ্যে ৩৭টি প্রকল্প উন্নয়ন পর্যায়ে রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রথম ধাপে রয়েছে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভ্যাকসিন কর্মসূচি, দুটি মার্কিন বায়োটেকনোলজি করপোরেশনের অধীনে এবং তিনটি চীনা বৈজ্ঞানিক দলের অধীনে পরীক্ষামূলক কাজ চলছে। অন্য ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীরা বলছে, চলতি বছরের মধ্যেই তারা মানুষের শরীরে এর প্রয়োগ পরীক্ষা চালাবে।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ভ্যাকসিন তৈরির দ্রুত প্রচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যেই ভ্যাকসিন চলে আসতে পারে। তবে, ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা পরীক্ষা করা জরুরি। ভাইরাস প্রয়োগে কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা বা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাই করার জন্য হাজারো মানুষের মধ্যে এর পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ কারণে কিছু গবেষক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ করছেন। এতে স্বাস্থ্যবান ও তরুণদের শরীরের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ পদ্ধতি অবশ্য একেবারে ঝুঁকিহীন নয়। তবে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএথিকসের অধ্যাপক নাইর ইয়াল বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের পরীক্ষার সময় অনেক কমিয়ে আনা যাবে।’

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম ফিন বলেছেন, ‘তরুণদের মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। এ ধরনের পরীক্ষায় অনেক তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। আমরা জানি না এটা কেন হয়। তবে, তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা বা অনেক মানুষের ওপর ভ্যাকসিনের প্রয়োগের সম্ভাবনা এখনো কিছুটা দূরে। ওই ধারণাটি আমাদের বিবেচনা করে দেখার সময় রয়েছে।’

Scroll to Top