উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’, দক্ষিণে ‘শাহবাজপুর ফল্ট’। এ দুই ফল্টের মধ্যখানে থাকা সিলেট আছে বিপদে। এই বিপদ যেকোনো সময় ধেয়ে আসতে পারে ভয়ানক হয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের জন্য ডেঞ্জার জোন (বিপজ্জনক এলাকা) সিলেট। সিলেট থেকে মাত্র ২শ’ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ডাউকি ফল্টের (ফল্ট হচ্ছে ভূগর্ভস্থ প্লেটের ফাঁক) অবস্থান। অন্যদিকে শাহবাজপুর ফল্টও (এটি হবিগঞ্জ-কুমিল্লা এলাকাধীন) সিলেটের কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুবই বেশি।
জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার ভোর রাতেও (সোমবার দিবাগত রাত) ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেট। ৩ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল গোয়াইনঘাটের জাফলং এলাকা। এ ভূমিকম্প সিলেটে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের তিনটি বলয় বা জোন চিহ্নিত করা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত।
সিলেট পড়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চল জোনে। অর্থাৎ, এখানে ভূমিকম্পের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
ইতিহাসের তথ্য বলছে, ১৫৪৮ সালে প্রচন্ড ভূমিকম্পে সিলেট এলাকায় ভূ-আকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই সময় উঁচু-নিচু ভূমি পরিণত হয় সমতল ভূমিতে। পরবর্তীতে ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৮১২ এবং ১৮৬৯ সালে হওয়া ভূমিকম্পে সিলেটের ভূ-মানচিত্র পাল্টে যায় অনেকটাই। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকালে সিলেটে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, সেটি ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থ কোয়াক’ নামে সমধিক পরিচিত।
ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭! ভয়াবহ সেই ভূমিকম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের ৫৪৫টি ভবন ভেঙে পড়ে। মানুষও মারা যায় অনেক। ওই ভূকম্পই সিলেটজুড়ে বিশালাকারের হাওর, বিল, জলাশয়ের সৃষ্টি করে। এদিকে, গেল শতাব্দিতে সিলেট অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলায় সংঘটিত হয় সে ভূমিকম্প।
এ শতাব্দিতে এখনও বড় মাত্রার ভূমিকম্প সিলেট অঞ্চলে সংঘটিত হয়নি। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় প্রতি ১শত বছর পর পর বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটতে পারে। সিলেটে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভয়ানক ভূমিকম্পের পর পেরিয়ে গেছে শত বছরেরও বেশি। ফলে এখন যেকোনো সময় বড় ধরনের আরেকটি ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ফরাসি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসার্টিয়াম ১৯৯৮ সালে যে জরিপ চালায়, সে জরিপে বলা হয়, সিলেট অঞ্চল ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে সক্রিয় ভূ-কম্পন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত। সাম্প্রতিক সময়ে এখানে ঘন ঘন ভূ-কম্পন্ন হচ্ছে। গেল প্রায় ছয় মাসে সিলেটে তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ভিাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেছিলেন, ‘ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ডাউকি থেকে সিলেট মাত্র ২শত কিলোমিটার দূরে। ডাউকি পয়েন্টে যদি ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে সিলেটে হবে ৫ মাত্রার মতো। সরাসরি সিলেটে যদি ৫ থেকে ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে ক্ষতি হবে ১০-২০ ভাগ। কিন্তু এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে।’
তবে ছোটখাটো ভূমিকম্প এ অঞ্চলের তেমন ক্ষতি করতে পারবে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। তবে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতিতে জোর দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।