ক্রাইস্টচার্চের মজসিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার সময়ে বাসে আটকে থেকে ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসামকে ফোন দিয়েছিলেন তামিম ইকবাল। এরপর তো কিছু না ভেবেই পাগলের মতো ছোটা শুরু করেছিলেন ইসাম। সঙ্গে ছিলেন আরও দুই বাংলাদেশী সাংবাদিক। তামিম পরে পুরো ঘটনার বর্ণনা করেছেন তার কাছে, যেটা প্রকাশিত হয়েছে ক্রিকইনফোতে। পাঠকদের জন্য যা হুবহু তুলে ধরা হল…
আগে বলি বাসে ওঠার আগে কী হয়েছিল। এই দুই-তিন মিনিট যে কী পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছে, সেটা বুঝতে সুবিধা হবে। সাধারণত যেটা হয়, মুশফিক আর রিয়াদ ভাই খুতবাহর সময় থাকতে চায় মসজিদে। এ কারণেই জুমার নামাজের সময় আমরা আগে যেতে চাই। বাস ছাড়ার কথা ছিল ১.৩০-এ, তবে রিয়াদ ভাই সংবাদ সম্মেলনে গিয়েছিলেন। সেখানে কিছু সময় গেছে। সেটা শেষ করে উনি ড্রেসিংরুমে ফিরে আসেন।
ড্রেসিংরুমে আমরা ফুটবল খেলছিলাম। তাইজুল ম্যাচটা হারতে চাইছিল না। তাইজুল আর মুশফিক ‘ওয়ান-অন-ওয়ান’ ম্যাচ খেলছিল, যেটাতে কয়েক মিনিট গেছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে এই ছোট ব্যাপারগুলোই।
ঠিক এর পরপরই আমরা বাসে উঠি। কথা ছিল, নামাজের পর টিম হোটেলে যাওয়ার। সৌম্য সরকার ও শ্রী (শ্রীনিবাস চন্দ্রশেকারান, টিম অ্যানালিস্ট) এ কারণেই আমাদের সঙ্গে ছিল (দুজনই সনাতন ধর্মালম্বী)। ঐচ্ছিক অনুশীলন বলে যারা মাঠে ফিরতে না চায়, তাদের হোটেলে চলে যাওয়ার কথা। আর যারা অনুশীলন করবে, তারা মাঠে ফিরে আসবে। পরিকল্পনা ছিল এমনই।
আমি সবসময়ই বাসে বাঁ দিকের ৬ষ্ঠ সারিতে বসি। মসজিদের কাছাকাছি যখন আমরা, ডানদিকের সবাই জানালা দিয়ে কিছু একটা দেখছিল। একটা শরীর পড়ে থাকতে দেখলাম আমি। স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছি, হয়তো মাতাল বা অজ্ঞান হয়ে গেছে। বাস সে কারণে থামেনি, মসজিদের কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। তবে সবাই পড়ে থাকা ওই মানুষটার দিক থেকে মনযোগ সরাতে পারেনি।
এসব যখন চলছে, আমার দৃষ্টি গেল আরেকজনের দিকে। শরীরে রক্ত। পড়ে যাব যাব করছে। আতঙ্ক ভর করলো ওই মুহুর্তেই।
আমাদের বাসটা থামলো মসজিদের কাছে একটা গাড়ির সামনে। বাস ড্রাইভার একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল, যে কাঁদছিল, কাঁপছিল। বলছিল, ভেতরে গোলাগুলি চলছে, যেও না যেও না।
আমাদের বাস ড্রাইভার জবাব দিয়েছিল, এরা মসজিদে যাবে। সে বললো, না না না। মসজিদে যেও না। মসজিদেই গোলাগুলি হচ্ছে। সে আবার কাঁদতে শুরু করলো। সবাই তার কথা শুনেছে, তাকে দেখতে পেয়েছে। আমাদের আতঙ্ক বাড়লো আরেকটু। সে সময় আমরা মসজিদ থেকে গজ বিশেক দূরে। বাস থেকে নেমে হেঁটে মসজিদে যেতে হবে এরপর- এমন দূরত্বে। মসজিদের আশেপাশে আরও কিছু রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখলাম আমরা তখন।
যখন আরও লাশ দেখলাম, আসলে বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। যারা টুপি পরে ছিল, তারা ভয়ে সেটা খুলে ফেললো। কিছু একটা হচ্ছে, সেটা বুঝছিলাম। যারা পাঞ্জাবি পরে ছিল, তারা এর ওপর জ্যাকেট চাপানো শুরু করল। আর কী করার ছিল বলেন?
বাসের মেঝেতে এরপর আমরা শুয়ে পড়লাম। সাত-আট মিনিট কেটে গেছে সেভাবেই। আমরা তখনও জানতাম না আসলে ব্যাপারটা কী, শুধু জানতাম উগ্র কিছু হচ্ছে।
বেশ ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা তখন আমাদের। আমার দিকে তাকান, ঠিকমতো কথাই বলতে পারছি না। বাস ড্রাইভারকে বলেছিলাম, সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে আমাদের। কিছু একটা করতে। তবে সে নড়ছিল না। সবাই তার দিকে চিৎকার করছিল। আমি চিৎকার করছিলাম। সেই ছয়-সাত মিনিটে কোনও পুলিশ ছিল না সেখানে।
হুট করেই পুলিশ হাজির হলো। এরপর স্পেশাল ফোর্স যেভাবে মসজিদের দিকে ছুটে গেল, আমরা হারিয়ে গেলাম যেন। অনুভূতিশুন্য হয়ে পড়েছিলাম। সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে আমার। আহত আর রক্তাক্ত আরও মানুষ বের হয়ে আসতে শুরু করেছে মসজিদ থেকে।
সে মুহুর্তে আমরা নিজেদের সামলাতে পারিনি। আমরা চিৎকার শুরু করেছিলাম, আমাদেরকে যেতে দাও। কেউ বলেছিল, যদি বের হওয়ার সময় গুলি করে। আবার কেউ বলেছিল, বাসে আটকা থাকাটা বিপদের। আমারও মনে হয়েছিল, বাস থেকে বের হলে একটা সুযোগ আছে আমাদের। বাসে থাকলে আমরা বড় একটা লক্ষ্যে পরিণত হব। কিন্তু যাবটা কই! বাসের দুইটা দরজাই তো বন্ধ।
ঠিক সে মুহুর্তে কোনও এক কারণে ড্রাইভার বাসটা দশ মিটারের মতো এগিয়ে নিল। আমি জানি না, সে কেন এটা করেছে। সে মুহুর্তে আমরা আসলে ভেঙে পড়লাম। সবাই হারিয়ে গেল যেন। মাঝের দরজায় আঘাত করা শুরু করলাম সবাই। দরজায় লাথি মারছিলাম, ঘুষি মারছিলাম। সে এরপর দরজা খুললো।
সে যখন বাস সামনে নিতে শুরু করেছে, আমি আপনাকে কল দেওয়া শুরু করি। আপনি ভেবেছিলেন আমি মজা করছি। ইসাম ভাই, সত্যি বলছি, আমি আপনাকে বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি হিতাহিত হারিয়ে ফেলেছিলাম যখন মাজহার (উদ্দিন, সাংবাদিক, ডেইলি স্টার) আমাকে কল দেওয়া শুরু করলো। আমি জানি না, কী হচ্ছিল তখন।
প্রায় আট মিনিট পর আমরা বাস থেকে বেরুতে পারি অবশেষে। সবাই বলছিল, পার্কের ভেতর দিয়ে দৌড় দিতে। আবার কেউ বলছিল, পার্কে সহজে লক্ষ্য করা যাবে আমাদের। যদি শ্যুটার আমাদের দেখতে পায়? গুলি করা শুরু করে?
এরপর যেটায় আরও বেশি ভয় পেলাম, আমাদের ব্যাগপত্র নিয়ে দৌড়াতে দেখে পুলিশ যেভাবে রি-অ্যাক্ট করা শুরু করলো। সেই সময়ে আমি আপনাদের তিনজনকে (ইসাম, মাজহার ও উৎপল শুভ্র) দেখতে পেলাম। তখন বুঝতে পারি নি, তবে কাল রাতে বুঝেছি, আপনারা কতো বড় ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন।
দুনিয়াতে খুব কম মানুষই আছে, যারা এমন ঝুঁকি নেবে। আমার মনে হয় না, খুব কাছের বেশি মানুষও ওই অবস্থায় হাজির হবেন, আপনারা যেভাবে এলেন। আমি আসলে আপনাদের দেখে স্বস্তি পেয়েছিলাম। বেশ কিছুদূর আসার পর সবাই মাঠের দিকে দৌড় দেওয়া শুরু করলো।
জানেন, নিজের চোখে লাশ দেখেছি। নিথর হয়ে যেতে দেখেছি মানুষের দেহ। এটা আমি কখনও ভুলব না। আর এমন একটা ব্যাপার, যতো সময় যাচ্ছে আরও বাজে অনুভূতি হচ্ছে। আমি বেশ কয়েকজন সতীর্থর সঙ্গে কথা বলেছি, সবাই এটা নিয়ে কথা বলছিল। একটা ভাল দিক হচ্ছে, সবাই মুখে হাসি ধরে রেখেছে। তবে বিশ্বাস করেন, ভেতরে ভেতরে সবাই বিধ্বস্ত।
হোটেলে ফিরে আমরা সোজা রিয়াদ ভাইয়ের রুমে গিয়েছিলাম। গুলি করার ভিডিওটা দেখছিলাম। ড্রেসিংরুমের মতো এখানেও ক্রিকেটাররা ফুঁপিয়ে উঠছিল।
একটা বিষয় নিশ্চিত, ইসাম ভাই। এটা কাটিয়ে উঠতে অনেক লম্বা সময় লাগবে। আশা করি আমাদের পরিবার সাহায্য করবে। আমাদের কাউন্সেলিং দরকার হতে পারে। যখনই চোখ বন্ধ করছি, ওই দৃশ্যগুলো দেখছি। গতরাতে সব ক্রিকেটারই দল বেঁধে ঘুমিয়েছে। আমি মিরাজ (মেহেদি হাসান) ও (মোহাম্মদ) সোহেল (টিম ম্যাসিউর) ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমিয়েছি। স্বপ্নে দেখেছি, ওরা একটা বাইকে গুলি করছে।
বিমানবন্দরের পথে আমরা বলাবলি করছিলাম, যদি ব্যাপারগুলো একটুও এদিক ওদিক হতো, হয়তো আমরা নয়, আমাদের লাশ যেতো এখন দেশে। ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যাপার ছিল শুধু।