বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল প্রথম ওয়ানডে জেতায়। তাতে গভীরভাবে তৈরি হয় সিরিজ জয়ের আত্মবিশ্বাস। মেহেদী হাসান মিরাজ তেমনটাই বলে গিয়েছিলেন আগের দিন। তাই বলে সাফল্য এভাবে ধরা দেবে, মিরাজ তো দূরে থাক, কারোর ভাবনাতেই আসার কথা নয়! কিন্তু তা-ই হলো! দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে বাংলাদেশ গড়লো ইতিহাস। ডি কক, বাভুমাদের ৯ উইকেটে হারিয়ে তাদের মাঠে প্রথমবার সিরিজ জয়ের উৎসব করলো তামিম, সাকিবরা।
গতকাল (বুধবার) সেঞ্চুরিয়নের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে ছিল সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ। প্রথম দুই ম্যাচ দুই দল একটি করে জেতায় ‘ফাইনালে’ রূপ নিয়েছিল লড়াইটি। যেখানে বাংলাদেশের একক আধিপত্য। ব্যাটিং-বোলিংয়ে আক্ষরিক অর্থেই প্রোটিয়াদের নিয়ে খেলেছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। প্রথমে তাসকিন আহমেদের তোপে ৩৭ ওভারে ১৫৪ রানে অলআউট করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। পরে ব্যাট হাতে শাসন করে ২৬.৩ ওভারে মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।
সিরিজ জয় তো দূরের কথা, এই সিরিজের আগে কখনও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে কোনও ফরম্যাটে জয় ছিল না বাংলাদেশের। এবারের মিশনে সেঞ্চুরিয়নের প্রথম ম্যাচেই ইতিহাস নতুন করে লিখে তামিমরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম জয় পায় সেঞ্চুরিয়নের ওয়ানডে দিয়ে। কিন্তু পরের ম্যাচে ওয়ান্ডারার্সে খেই হারালে প্রোটিয়ারা সমতা ফেরায় সিরিজে। আজ সেই সেঞ্চুরিয়নে ফিরে দাপুটে পারফরম্যান্সে তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে শেষ করলো বাংলাদেশ।
১৪১ বল আগে মাত্র ১ উইকটে হারিয়ে জয়, বোঝাই যাচ্ছে কতটা দাপট দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সহজ লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে দুর্দান্ত শুরু পায় সফরকারীরা। মনে হচ্ছিল, দুই ওপেনার তামিম ইকবাল-লিটন দাস মিলেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেবেন দলকে। উদ্বোধনী জুটিতে তারা যোগ করেন ১২৭ রান। জয় থেকে তখন কেবল ২৯ রান দূরে সফরকারীরা। সেই সময় আউট হয়ে যান কেশব মহারাজের সৌজন্যে একবার ‘জীবন’ পাওয়া লিটন। ক্যাচ মিস করা ওই মহারাজের বলেই তেম্বা বাভুমার হাতে ধরা পড়েন ডানহাতি ব্যাটার। ফেরার আগে ৫৭ বলে ৮ বাউন্ডারিতে খেলে যান ৪৮ রানের ইনিংস।
লিটন আউট হলেও দলের জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছেড়েছেন তামিম। এই সিরিজে ধীরগতিতে রান তোলায় সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হওয়া বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক শেষ ম্যাচে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। অপরাজিত ৮৭ রানে সহজ লক্ষ্য আরও সহজ করে দিয়েছেন তিনি। ৮২ বলের চমৎকার ইনিংসটি তামিম সাজান ১৪ বাউন্ডারিতে। অন্যদিকে উইনিং শটে সিরিজ জয় রাঙিয়ে নেওয়া সাকিব ২০ বলে ২ বাউন্ডারিতে অপরাজিত থাকেন ১৮ রানে।
তামিমের অসাধারণ ব্যাটিং কিংবা সাকিবের উইনিং শট- সেঞ্চুরিয়নের ম্যাচে সব ঢাকা পড়েছে তাসকিনের আলোতে। বাংলাদেশের সহজ জয়ের ভিত তো গড়ে দিয়েছিলেন এই পেসাররই। সেঞ্চুরিয়নের শেষ ওয়ানডেতে এককথায় বল হাতে আগুন ঝরিয়েছেন তাসকিন। করোনাভাইরাসের প্রকোপে সব ক্রিকেট যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাসকিন ছিলেন নিজেকে ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে। চোট ও ফর্মহীনতায় হুমকির মুখে পড়ে যাওয়া ক্যারিয়ার এমনভাবে ছন্দে ফেরালেন যে তার পেস আগুনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটাররা। এবারের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রোটিয়া ব্যাটারদের ছিল বেহাল অবস্থা। তার তোপে দাঁড়াতেই পারেননি কেউ! ৯ ওভারে মাত্র ৩৫ রান দিয়ে ৫ উইকেট পাওয়া এই পেসারের হাতেই উঠেছে ম্যাচ ও সিরিজ সেরার পুরস্কার।
জোড়া আঘাতে ৫ উইকেট তুলে নিয়েছেন তাসকিন। ২৯তম ওভারের তৃতীয় বলে ডেভিড মিলারকে আর দুই বল পর কাগিসো রাবাদাকে আউট করে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার ৫ উইকেট পূরণ করেন ২৬ বছর বয়সী পেসার। সাকিব আল হাসানও আলো ছড়িয়েছেন, ৯ ওভারে মাত্র ২৪ রান খরচায় নিয়েছেন ২ উইকেট। আর একটি করে উইকেট শিকার শরিফুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজের।
এমনিতেই স্বাগতিকদের ব্যাটিং লাইনআপের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন তাসকিন। তারপরও মিলার থাকায় কিছুটা হলেও আশা বেঁচে ছিল। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে ছিলেন বাঁহাতি ব্যাটার। তবে তার লড়াই বেশিক্ষণ টিকেনি। তাসকিনের লেগ স্টাম্পের বাইরের বাউন্স থাকা বল খেলতে গিয়ে উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসবন্দি হন মিলার। হতাশ হয়ে ফেরার আগে ৩১ বলে ২ বাউন্ডারিতে করে যান ১৬ রান।
দুর্দান্ত সময় কাটানো তাসকিনের উইকেট উদযাপনের শেষটা এখানেই নয়। ওই ওভারেই রাবাদাকে ফিরিয়ে পান ৫ উইকেট। নিচু ক্যাচ দারুণ দক্ষতায় গ্লাভসে নেন মুশফিক। রাবাদা ৩ বলে ১ বাউন্ডারিতে করেন ৪ রান। এরপর সাকিবের বলে লুঙ্গি এনগিদি শূন্য রানে ফেরেন। বাংলাদেশের বোলারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে প্রোটিয়াদের রান দেড়শ’ ছাড়াবে কিনা, সংশয় ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা ১৫৪ রান করতে পেরেছে কেশব মহারাজের চমৎকার ব্যাটিংয়ে। শেষ ব্যাটার হিসেবে তিনি রান আউট হওয়ার আগে খেলেন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮ রানের ইনিংস। ৩৯ বলের ইনিংসটি মহারাজ সাজান ৪ বাউন্ডারিতে।
তৃতীয় ওয়ানডেতে শুরুটা কিন্তু দারুণ হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। ৭ ওভারে উইকেট না হারিয়ে তুলে ফেলে ৪৬ রান। কিন্তু কুইন্টন ডি কককে ফিরিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ রাশ টেনে ধরার পর জোড়া আঘাতে স্বাগতিকদের বিপদে ফেলেন পেসার তাসকিন আহমেদ। তুলে নেন কাইল ভেরিয়েনে ও আগ্রাসী ভঙ্গিতে খেলতে থাকা জানেমান মালানের উইকেট। পরে সাকিব আল হাসান উইকেট উৎসবে যোগ দিলে চাপে পড়ে যায় স্বাগতিকরা। এখানেই শেষ নয়, খানিক পর শরিফুল ইসলাম উইকেটের খাতা খুললে বিপদ বাড়ে প্রোটিয়াদের। তাতে ৮৩ রানে হারায় ৫ উইকেট।
সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুরুটা হয়েছিল কুইন্টন ডি কককে হারিয়ে। মেহেদী হাসান মিরাজের আগের বলে চার মারা ডি কক পরের বলে ধরা পড়েন মাহমুদউল্লাহর হাতে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ঝড় তোলা প্রোটিয়া ব্যাটার আজ ফিরেছেন মাত্র ১২ রানে।
প্রথম উইকেট পড়ার পর বাক্সবন্দি হয়ে পড়েন আরেক ওপেনার জানেমান মালান। শুরুর আগ্রাসনটা কমিয়ে তার ইনিংস গড়ার পথে কাইল ভেরিয়েনে সঙ্গী হতে চাইলেও তাকে থিতু হতে দেননি তাসকিন। বল ব্যাটের কানায় লেগে আঘাত হানে ভেরিয়েনের স্টাম্পে। তার আগে এই ব্যাটার এক চারে করতে পারেন ৯ রান। প্রোটিয়াদের বিপদ আরও বাড়িয়ে দেন তাসকিন। শুরুতে আগ্রাসী ভঙ্গিতে খেলা মালানকে দারুণ এক ডেলিভারিতে গ্লাভসবন্দি করিয়েছেন তিনি। তাতে ৫৬ বলে ৭ চারে ৩৯ রানে শেষ হয় মালানের ইনিংস।
এরপর সাকিব ক্রিজে আসা তেম্বা বাভুমাকে এলবিডব্লিউতে ফেরালে ভীষণ চাপে পড়ে যায় স্বাগতিকরা। প্রোটিয়া অধিনায়ক রিভিউ নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। আউট হয়েছেন মাত্র ২ রান করে। কঠিন চাপে পড়া প্রোটিয়াদের আশা হয়ে বেঁচে ছিলেন তখন ফন ডের ডুসেন ও ডেভিড মিলার। সেঞ্চুরিয়নের প্রথম ওয়ানডেতেও বিপদের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু এবার আর হয়নি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ধারাবাহিক পারফর্ম করতে থাকা ফন ডের ডুসেন পারেননি। তাকে বেশি দূর যেতে দেননি শরিফুল। এই বাঁহাতি পেসারের অপ্রত্যাশিত বাউন্সারে খেই হারিয়ে মিরাজকে সহজ ক্যাচ দিয়ে মাত্র ৪ রানে বিদায় নেন প্রোটিয়া ব্যাটার।
সেই আসা-যাওয়া শেষ পর্যন্ত চলেছে। প্রোটিয়ারা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এমনি সেটা ব্যাটিংয়ের পর বোলিংয়েও। বিপরীতে দুর্দান্ত ক্রিকেটের প্রদর্শনীতে একক আধিপত্যে ইতিহাস লিখেছে বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
দক্ষিণ আফ্রিকা: ৩৭ ওভারে ১৫৪ (মালান ৩৯, মহারাজ ২৮, প্রিটোরিয়াস ২০, মিলার ১৬, ডি কক ১২; তাসকিন ৫/৩৫, সাকিব ২/২৪, মিরাজ ১/২৭)।
বাংলাদেশ: ২৬.৩ ওভারে ১৫৬/১ (তামিম ৮৭*, লিটন ৪৮, সাকিব ১৮*; মহারাজ ১/৩৬)।
ফল: বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচের ওয়ানডে বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: তাসকিন আহমেদ।
সিরিজের সেরা: তাসকিন আহমেদ।