ঈদুল আজহায় আমাদের করণীয় ও বর্জনীয়

মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ
ঈদুল আজহার দিনটি অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনে সবচেয়ে বড় ইবাদত হল কোরবানি। হজরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- আদম সন্তান (মানুষ) কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করা (কোরবানি করা) অপেক্ষা আল্লাহর নিকটে অধিক প্রিয় কাজ করে না। নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন (কোরবানি দাতার পাল্লায়) কোরবানির পশু, এর শিং, এর লোম ও এর খুরসহ এসে হাজির হবে এবং কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত স্থানে পৌঁছে যায়। সূতরাং তোমরা কোরবানি করে সন্তুষ্ট চিত্তে থাকো। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

ঈদুল আজহা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। পবিত্র এ দিনটিতে আল্লাহর প্রিয় জিনিস হিসেবে পশু উৎসর্গ করা হয়। কোরবানির ভেতর দিয়ে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিকে অগ্রসর হয় মুসলমান সম্প্রদায়। কোরবানির অর্থ হচ্ছে উৎসর্গ করা। পশু কোরবানি হচ্ছে তার মাধ্যম।

ত্যাগের মহিমার এক প্রতীকী আচার এ কোরবানি যে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণ মূর্ত হয় মানুষের জীবনে, তার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারের প্রতীক কোরবানি। ঈদুল আজহার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিজের অহমিকা ও উচ্চাভিলাষ উৎসর্গ করা। পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে মানুষের ভেতরের পশুশক্তি, কাম-ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকে কোরবানি দিতে হয়।

ঈদুল আজহায় করণীয় দিকসমূহ
ইসলামের এ দুটি উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিনই নয়। বরং এ দিন দুটোকে আনন্দ-উৎসব এর সাথে সাথে জগৎসমূহের প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগী দ্বারা সুসজ্জিত করা।

যিনি জীবন দান করেছেন, দান করেছেন সুন্দর আকৃতি, সুস্থ শরীর, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, পরিবার-পরিজন, যার জন্য জীবন ও মরণ তাকে এ আনন্দের দিনে ভূলে থাকা হবে আর সব কিছু ঠিকঠাক মত চলবে এটা কীভাবে মেনে নেয়া যায়?

তাই ইসলাম আনন্দ-উৎসবের এ দিনটাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত-বন্দেগী, তার প্রতি শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দ্বারা সু-সজ্জিত করেছে। তাই ঈদুল আজহায় যে সমস্ত বিষয় আমাদের করণীয় রয়েছে তা নিচে আলোচনা করা হল

গোসল করাঃ ঈদের সালাতের পূর্বে গোসল করা সুন্নাত। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) ঈদের নামাযে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)

উত্তম পোষাক পরিধানঃ ঈদের দিন রাসূল সা. ভাল পোষাক পরিধান করতেন। হাদীসে আছে রাসূল সা. এর লাল ও সবুজ ডোরার একটি চাদর ছিল, তিনি তা দুই ঈদ এবং জুমুয়ার দিন পরিধান করতেন। অপর দিকে রাসূল সা. তার সকল দাসীকে ঈদের দিনে হাতে পায়ে মেহদী লাগানোর নির্দেশ দিতেন।

বিধায় সামর্থ অনুযায়ী নতুন পোষাক ক্রয় করা অথবা পুরাতন পোষাকটাকে পরিষ্কার করে ইস্ত্রি দিয়ে ব্যবহার করা। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পোষাকের ব্যবস্থা করা। প্রতিবেশী শিশুদের জন্য সামর্থ অনুযায়ী পোষাকের ব্যবস্থা করে দেওয়া।

সুগন্ধি ব্যবহারঃ সুগন্ধি ব্যবহার সুন্নাত। আর ঈদের দিনে রাসূল সা. বিশেষ ভাবে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। রাসূল সা. এর তিনটি পছন্দনীয় জিনিসের মাঝে একটি হলো সুগন্ধি। তাই ঈদের দিনের পোষাক পরিধানের পর সুগন্ধি ব্যবহার করা। সুগন্ধি মানে এলকোহল মিশ্রিত ভ্যাপসা গন্ধ সম্পন্ন স্প্রে নয়, বরং দেহনাল উদ বা আতর ব্যবহার করা।

ঈদের দিনে খাওয়াঃ কোরবানির দিনে ঈদের নামাজের আগে কোন কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে ঈদুল ফিতরের দিনে নামাজের আগে কিছু খাওয়া মুস্তাহাব। হযরত বুরাইদাহ আসলামী রা. হতে বর্ণিত।

তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন নামাজের উদ্দেশ্যে বের হতেন না, যতক্ষণ না তিনি কিছু খেতেন। আর ঈদুল আযহার দিন কিছুই খেতেন না যে পর্যন্ত ঈদের নামাজ আদায় করতেন। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী)

ঈদগাহে যাওয়াঃ ঈদগাহে এক পথ দিয়ে যাওয়া ও অপর পথ দিয়ে ফেরা সুন্নাত, (সহীহুল বুখারী- ৯৮৬)। সম্ভব অনুযায়ী ঈদগাহে পায়ে হেটে যাওয়াও সুন্নাত, (ইবনু মাজাহ- ১০৭১)

তাকবীর পাঠ করাঃ ঈদের দিন তাকবীর পাঠের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালাকে বেশী বেশী স্মরণ করা। পুরুষেরা উঁচু আওয়াজে পাঠ করবে, মেয়েরা নিরবে। মূলত: এ তাকবীর যিলহজ্জ মাসের এক তারিখ হতে ১৩ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাঠ করার সময়। (ফাতহুল বারী-২/৫৮৯, সহীহ ফিকহুস্ সুন্নাহ্-১/৬০৩ পৃঃ)

ঈদের নামায আদায়ঃ ঈদের নামায শুরু হয় ১ম হিজরীতে। নবী সা. ঈদের নামায নিয়মিত আদায় করেছেন এবং মুসলামানদের ঈদের জামায়াতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন। ঈদের নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ঈদের নামায সকল নফল সালাতের মাঝে ফজিলতপূর্ণ। ঈদের নামাযের পূর্বে এবং ফজরের নামাযের পরে কোন নামায নেই। ঈদের নামাযের কোন আযান এবং একামাতও নেই।

খুতবা শ্রবণ করাঃ প্রথমে ঈদের সালাত অতঃপর খুতবা। সালাতের আগে খুতবা দেয়া নিষিদ্ধ। খতিব সাহেব খুতবার সময় উপযোগী বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর করণীয়-বর্জনীয় এবং প্রেরণা মূলক বক্তব্য রাখবেন। মহিলারা উপস্থিত হলে তাদের বিষয়েও বক্তব্য রাখা।

শুভেচ্ছা বিনিময়ঃ ঈদের দিনে ছোট বড় সকলের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা। ঈদের দিনে সাহাবায়ে কিরামদের সম্ভাষণ ছিল-(আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বাল মিন্না ওয়া মিনকা)। বিধায় আমাদেরও সাহাবায়ে কিরামদের সম্ভাষণ ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন।

দোয়া ও ইস্তেগফার করাঃ ঈদের দিনে আল্লাহ তায়ালা অনেক বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। মুয়ারিরক আলইজলী রহ. বলেন, ঈদের এই দিনে আল্লাহ তায়ালা একদল লোককে এভাবে ক্ষমা করে দিবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল।

নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের জামায়াতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে।’ (লাতাইফুল মায়ারিফ)

কোরবানি করাঃ ঈদুল আজহার দিনে সামর্থবান ব্যক্তিদের উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন- সামর্থ থাকা সত্বেও যে কোরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। ( মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)। কোরবানি একটি ফজিলত পূর্ণ ইবাদত। কোরবানির ফজিলতের ব্যাপারে কুরআন এবং হাদীসে অনেক বর্ণনা এসেছে।

হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবীগণ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই কোরবানী কি?

রাসুল (সা.) জওয়াবে বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহিম আ. এর সুন্নাত (রীতিনীতি)।

তাকে আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের কি (পূণ্য রয়েছে)?

রাসূল (সা.) বললেন, (কোরবানির জন্তুর) প্রতিটি লোমের পরিবর্তে নেকী রয়েছে। তারা আবারও বললেন, পশমওয়ালা পশুদের জন্য কি হবে? (এদের তো পশম অনেক বেশী)। রাসূল (সা.) বলেছেন, পশমওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তেও একটি করে নেকী রয়েছে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ)

কোরবানির পশু যত সুস্থ, সুন্দর ও নিখুত হবে ততো ভালো। তবে কানা, অন্ধ, লেংরা এবং অতি রুগ্ন ও দুর্বল যেন না হয়, কারণ এমন পশু কুবানীর উপযুক্ত নয়, (ইবনু মাজাহ-৩১৪৪)।

অনুরূপ কান কাটা ও শিং ভাংগা মুক্ত হাওয়া ভালো। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ-২/৩৭৩ পৃঃ)। মনে রাখতে হবে, এ কোরবানি তাকওয়ার পরিচয়। সুতরাং আপনার তাকওয়া কিভাবে প্রমাণ করবেন তা আপনিই ভাল জানেন।

কোরবানির পশু যবেহ করতে দেখা ও সহযোগিতা করাঃ নিজের কোরবানির জানোয়ার নিজ হাতে যবেহ করাই মুস্তাহাব। যদি নিজে যবেহ করতে না পারে, তবে অন্যের দ্বারা যবেহ করাবে, কিন্তু নিজে সামনে দাড়িয়ে থাকা ভাল।

ঠিক তদ্রুপ অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে নিজে কোরবানি করতে না পারলেও অন্যের পশু কোরবানি করতে দেখা এবং তাদেরকে সহযোগিতা করা। মেয়ে লোকদের পর্দার ব্যাঘাত না হলে কোরবানির সময় সামনে থাকতে পারবে। তবে পর্দার ব্যাঘাত হলে কোরবানির সময় সামনে না থাকলে কোন ক্ষতি হবে না।

হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে লক্ষ্য করে বলেনঃ তুমি উঠো, তোমার কোরবানির কাছে যাও এবং তা দেখ। কেননা কোরবানির যে রক্ত প্রবাহিত হয় তার প্রতি বিন্দুর বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তোমার অতীত গুনাহ মাফ করে দেবেন।

হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ আপনার ও আপনার পরিবার বর্গের লোকদের জন্যই কি এই বিশেষ ব্যবস্থা, নাকি সব মুসলমানের জন্য? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হ্যাঁ, আমাদের এবং সব মুসলমানের জন্যই এ ব্যবস্থা। (বায্যার)

কোরবানির গোশত বিতরণ: কোরবানির গোশত নিজে খাবে, নিজের পরিবারবর্গকে খাওয়াবে, আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া তোহফা দিবে এবং গরীব মিসকীনকে দান করবে। মুস্তাহাব তরীকা হলো কোরবানির গোশত তিন ভাগে ভাগ করা।

১. নিজ পরিবার পরিজনের জন্য এক ভাগ।
২. আত্মীয় স্বজনের জন্য এক ভাগ।
৩. ফকীর মিসকীনদের জন্য একভাগ।

আর যদি পরিবারের লোক সংখ্যা বেশী হয় তবে কোরবানির সমস্ত গোশত খেলেও অসুবিধা নেই। তবে কেহ যদি ফকীর মিসকীনকে সামান্যও দান করে তাতেও গুনাহ হবে না। (শামী ৫/২০৮)

রক্ত, আবর্জনা ও হাড় পরিষ্কার করাঃ ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর রক্ত, আবর্জনা ও হাড় থেকে যেন পরিবেশ দূষিত না হয় সে দিকে প্রত্যেক মুসলমানদের সতর্ক হওয়া উচিৎ। কোরবানি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত, আবর্জনা ও হাড় নিরাপদ দূরুত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেয়া।

সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং এলাকার নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করাই ভালো। নির্দিষ্ট স্থানে সম্মিলিতভাবে কোরবানি করলে অনেকাংশে পরিবেশ যেমন ভালো থাকে ঠিক তেমনি আনন্দের পরিমাণও বেশী হয়। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে কোরবানির অনুরোধ করা হলেও বেশির ভাগ লোকই নিজস্ব জায়গায় পশু জবাই করে।

এতে করে অলিগলিতে বর্জ যেমন পড়ে তেমনি রক্ত পড়ে দূষিত হয় পরিবেশ, চলাচলের অনুপযোগী হয় রাস্তাঘাট। তাই ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর রক্ত, আবর্জনা পরিষ্কারে সরকারী উদ্যেগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ভাবেও উদ্যোগ গ্রহণ করে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে কাজ করা।

গরীবদের সাহায্য করাঃ ইয়াতিমের খোঁজ-খবর নেয়া, তাদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কুরআনে বলা হয়েছে, তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, এতিম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে (সূরা আদদাহর : ৮)

কোরবানির ঈদ প্রসঙ্গে স্বভাবতই একটি প্রশ্ন এসে যায়। আমরা কি শুধু কোরবানির সময়েই গরীব-দুঃখী মানুষ আহার করানোর কথা চিন্তা করবো? আর বছরের বাকি দিনগুলো কি তাদেরকে ভুলে থাকবো? না, অবশ্যই না। কোরবানি একটি প্রতিকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র।

সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগ করতে হবে। এই ত্যাগের মনোভাব যদি গড়ে ওঠে তবে বুঝতে হবে, কোরবানির ঈদ স্বার্থক হয়েছে, কোরবানি স্বার্থক হয়েছে। নইলে এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল।

আল-কুরআনে আল্লাহ বারবার ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের উপার্জিত হালাল মালের কিছু অংশ এবং আমি যা তোমাদের জন্য যমীন হতে বের করেছি তার অংশ ব্যয় কর’ (বাক্বারাহ ২৬৭)।

ঈদুল আজহায় বর্জনীয় দিকসমূহ
ঈদ হল মুসলমানদের শান-শওকত প্রদর্শন, তাদের আত্মার পরিশুদ্ধতা, তাদের ঐক্য সংহতি ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বহু মুসলিম এ দিনটাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে জানে না। তারা এ দিনে বিভিন্ন অনৈইসলামীক কাজ-কর্মে মশগুল হয়ে পড়ে। এ ধরনের কিছু কাজ-কর্মের আলোচনা করা হল:

ঈদের দিনে রোজাঃ ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম। ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)

ঈদের দিনকে কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করাঃ ঈদের দিন কবর যিয়ারতের বিশেষ দিন মনে করে যিয়ারত করা বিদআত (সহীহ্ ফিকহুস সুন্নাহ- ১/৬৬৯) তবে পূর্ব নির্ধারিত রুটিন ছাড়া হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেলে একাকী কেউ যিয়ারত করলে দোষনীয় নয়।

ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ ফুর্তি করাঃ অনেকে ঈদের আনন্দে মশগুল হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান, সেমাই, ফিরনী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ঈদের সালাত আদায় করার কথা ভুলে যায়। অথচ এই দিনে ঈদের সালাত ও কোরবানি করাই হচ্ছে মুসলমানদের মূল কাজ।

মুসাফাহা মুআনাকা এই দিনে করতে হবেই এটা মনে করাঃ ঈদগাহে বা ঈদের দিন সাক্ষাত হলে মুসাফাহা ও মুআনাকা করতেই হবে এমন বিশ্বাস ও আমল করা বিদআত। তবে এমন বিশ্বাস না করে সালাম ও মুসাফাহার পর মু‘য়ানাকা (গলায় গলা মিলানো) করায় কোন অসুবিধা নেই। কারণ মুসাফাহা ও মুআনাকা করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, ‘একদা হাসান ইবনে আলী রা. নবী কারীম (সা.) এর নিকট আসলেন, তিনি তখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং মুআনাকা (কোলাকুলি) করলেন।’

যে সব পশু কোরবানি করা জায়েয নয়ঃ হযরত বারা ইবনে আযেব রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসূলূল্লাহ (সা.)- কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, কোরবানির ব্যাপারে কোন ধরনের জন্তু হতে বেঁচে থাকতে হবে?

রাসূল (সা.) হাতের দ্বারা (অর্থাৎ চার আঙ্গুল দেখিয়ে) বললেন, চার রকমের পশু হতে-

১. খোঁড়া- যার খোঁড়ামি স্পষ্ট,
২. কানা- যার অন্ধত্ব স্পষ্ট,
৩. রোগা- যার রোগ স্পষ্ট এবং
৪. দুর্বল- যার হাড়ে মজ্জা নেই। (মালেক, আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও দারেমী)

দুর্বল, জীর্ণ, শীর্ণ, এক পা খোড়া (যে পায়ে একেবারেই শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না), গোড়া থেকে শিং ভাঙ্গা, কান ও লেজ অধিকাংশ কাটা, অন্ধ ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি জায়েয নহে। (দুররুল মুখতার ৫/২২৭)

ছাগলের দুধের যদি একটা বাট না থাকে এবং গাভী অথবা উটের দু’টি বাট না থাকে তবে কোরবানি জায়েয হবে না। (হিন্দিয়া ৬/২৯৪, শামী ৫/২০৬)

কোরবানির কোন কিছু বিক্রি করাঃ কোরবানির গোশত, চামড়া কোন কিছুই বিক্রয় করা যাবে না। অর্থাৎ বিক্রয় করে নিজে উপকৃত হওয়া যাবে না। এমনকি কসাইকে পারিশ্রমিক স্বরূপ গোশত দেয়াও নিষিদ্ধ, (সহীহুল বুখারী- ১৭১৭, সহীহ্ মুসলিম- ১৩১৭)। তবে সাধারণ ভাবে তাকে খেতে দেওয়াতে অসুবিধা নেই।

গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখাঃ ঈদের দিন উপলক্ষে ঈদমেলা যেখানে গান-বাজনা, অবাধে নারী-পুরুষ বিচরণ ইত্যাদির আয়োজন থাকে এমন মেলা আয়োজন করা, অংশগ্রহণ ও সহযোগীতা দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।

অনুরূপ ঈদ উপলক্ষে বাড়ী-ঘরে গান-বাজনার বিশেষ আয়োজন, নারী-পুরুষের বিশেষ সাক্ষাত ও অবাধে যেখানে সেখানে ঘুরাফেরা, এসবই অমুসলিমদের কালচার। মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম, (সূরা আলে ইমরান-১৪৯, সূরা লুকমান-৬,৭) বরং মুসলিম সমাজের কর্তব্য হল আল্লাহর আনুগত্যের মধ্য দিয়ে ঈদ পালন করে তাঁকে আরো খুশি করা।

ঈদের দিনে মহিলা-পুরুষের বেপরোয়া দেখা-সাক্ষাৎঃ মেয়েরাও ঈদগাহে যাবে কিন্তু খুবই শালীনতা ও সংযমতার সাথে। বে-পর্দা ও অশালীন ভাবে নয়। অপর পুরুষের সাথে গল্প গুজব ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করে নয় ফলে সাওয়াবের পরিবর্তে আরো গুনাহগার হবে। দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকট আত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরিয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়।

পুরুষ কর্তৃক মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলা কর্তৃক পুরুষের বেশ ধারণঃ পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে পুরুষের মহিলার বেশ ধারণ ও মহিলার পুরুষের বেশ ধারণ করা হারাম। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়।

হাদীসে এসেছে, ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম (সা.) ঐ সকল মহিলাকে অভিসম্পাত করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং ঐ সকল পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন যারা মহিলার বেশ ধারণ করে। (সহীহ আল-জামে- ৪৫৮৪ )

উপসংহারঃ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ’। মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহীম (আঃ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন।

মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। আর ঈদুল আজহার মূল আহবান হল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হতে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই হল ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা।

লেখক:
সভাপতি- বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ, টাঙ্গাইল জেলা।
Email- azad91bd@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, ২৮ আগস্ট ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসডিএম