মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আর মানুষ আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি। তিনি সবচেয়ে সুন্দর অবয়বে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে কত সুন্দর করে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তা বলেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন, আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে সৃষ্টি করেছি। (সুরা মুমিনুন, আয়াত: ১২-১৪)।
তিনি আরও বলেন, এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত, অতঃপর আমি একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমি কত সুনিপুণ স্রষ্টা। (সুরা মুরসালাত, আয়াত: ২২-২৩)।
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে এভাবে বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, শিশুর আমল, রিজিক, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেয়া হয়। (বুখারি: ২৯৬৮)।
নবীজি আরও বলেন, আল্লাহ মাতৃগর্ভে একজন ফেরেশতা মোতায়েন করেন। ফেরেশতা বলেন, হে রব! এখনও তো ভ্রূণ মাত্র। হে রব! এখন জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। হে রব! এবার গোশতের টুকরায় পরিণত হয়েছে। আল্লাহ যদি তাকে সৃষ্টি করতে চান, তখন ফেরেশতা বলেন, হে আমার রব! (সন্তানটি) ছেলে না মেয়ে হবে, পাপী না নেককার, রিজিক কী পরিমাণ ও আয়ুষ্কাল কত হবে? অতএব, এভাবে তার তকদির মাতৃগর্ভে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়। (বুখারি: ৩০৮৭)।
মাতৃগর্ভ থেকে মানুষের বেড়ে ওঠা শুরু হয়। বর্তমানে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন উপায়ে গর্ভপাত ঘটিয় থাকে। এটাকে এবোরশন বলে (Abortion) বলে।
এটি জন্মনিয়ন্ত্রণের বহু পুরানো একটি পদ্ধতি। কোনো শরিয়াহ অনুমোদিত কারণ ছাড়া এ পদ্ধতি নাজায়েজ। তবে যদি নারী অত্যধিক দুর্বল হয়, যার কারণে গর্ভধারণ তার জন্য আশঙ্কাজনক হয়। গর্ভধারণের মেয়াদ চার মাসের কম হয়। তাহলে অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে গর্ভপাতের অবকাশ আছে। তবে গর্ভের সময় চার মাসের বেশি হলে কোনোভাবেই বৈধ হবে না।
বর্তমান সমাজে গর্ভপাত বা ভ্রূণহত্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে অসংখ্য তরুণী! কিছু নষ্ট চরিত্রের ফসল। কেউ আবার দারিদ্র্যের ভয়ে। আবার কেউ করে সমাজের ভয়ে। এখন সামাজিক মহামারির আকার ধারণ করেছে এবোরশন।
শুধু কোরআন-হাদিসেই নয়– চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ভ্রূণের বয়স যখন তেতাল্লিশ দিনের কম হয় তখন ভ্রূণ একটি রক্তপিণ্ড হিসেবে মায়ের গর্ভে অবস্থান করে। তখনও তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দৃশ্যমান হয় না।
এ অবস্থায় ভ্রূণটি মানুষের শরীরের একটা অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর মানুষের প্রতিটি অঙ্গের মালিক স্বয়ং মহান আল্লাহ। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো এটিও নষ্ট করা নাজায়েজ। তবে যদি স্তন্যদানকারিনী গর্ভবতী হয়, দুধ বন্ধ হওয়া, দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণ নাশের আশঙ্কা হয়, গর্ভের বীর্য শুধু জমাট রক্ত কিংবা গোশতের টুকরা আকারে থাকে, কোনো অঙ্গ দৃশ্যমান না হয় তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভপাত ঘটানো জায়েজ আছে। (ফতওয়ায়ে কাজিখান: ৩/৪১০)।
ভ্রূণের বয়স যখন তেতাল্লিশ দিন হয়ে যায়, তখন থেকে তার প্রয়োজনীয় অরগ্যান, যেমন ফুসফুস, নাক, হাত ও বিশেষ কিছু হাড় ইত্যাদি প্রস্তুত হওয়া শুরু হয়। অতএব তখন থেকে শুরু করে চার মাস পর্যন্ত গর্ভপাতের মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় ভ্রূণটি নষ্ট করে ফেলা মাকরুহে তাহরিমি। (আদ্দুররুল মুখতার: ১০/২৫৪)।
ভ্রূণের বয়স যখন ১২০ বা চার মাস হয়ে যায়, তখন মহান আল্লাহ তার মধ্যে রুহ দান করেন। আর রুহ আসার পর বাচ্চা নষ্ট করা কোনো মানুষকে হত্যা করার শামিল। তাই এ সময় ভ্রূণহত্যা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। (ফতহুল আলিয়্যিল মালিক খ. ১/৩৯৯)।
আধুনিক যুগে ভ্রূণহত্যা জাহেলি যুগে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত সমাধিস্থ করার নামান্তর। তখন বাবা নিজ মেয়েকে গর্তে পুঁতে ফেলত; আর এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা মায়ের পেটেই শিশুকে মেরে ফেলা হয়। এ দুই হত্যার মধ্যে কোনো তফাত নেই।
এজন্য নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভ্রুণহত্যাকে ‘গুপ্তহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, স্মরণ কর ওই দিনকে, যেদিন জীবন্ত সমাধিস্থ নিষ্পাপ বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধের কারণে হত্যা করা হয়েছে? (সুরা তাকভির: ৮)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, যে একটি জীবনকে হত্যা করা থেকে বিরত থেকেছে, সে যেন সব মানুষের জীবনকে হত্যা করা থেকে বিরত থেকেছে; আর যে একটি আত্মাকে হত্যা করেছে, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করেছে। (সুরা মায়েদা:৩০)।
অনেকে মনে করেন, আগত শিশুকে লালনপালন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এই ভয়ে ভ্রূণ মেরে ফেলেন। এ কাজটি নিতান্তই নিন্দনীয় ও বোকামি। কেননা যিনি তার বান্দাকে এত যত্ন করে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তার রিজিকেরও ব্যবস্থা করবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানকে দারিদ্র্যের ভয়ে হত্যা করো না। আমি তোমাকে ও তোমার সন্তানকে দেখেশুনে রাখি। তাই তাদের হত্যা করা সত্যিকার অর্থেই একটি মহাপাপ। (সুরা ইসরা: ৩২)।
মুফতি জাকারিয়া হারুন