রোগীর সেবা করার গুরুত্ব ও ফজিলত

শুধু নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতই ইবাদত না। একজন মুসলিমের প্রতিটি ভালো কাজই ইবাদত। এর জন্য শুদ্ধ নিয়ত করা জরুরি। কেউ ফজর নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে ঘুমালে তার ঘুমও ইবাদত বলে গণ্য হয়।

ইসলামে ইবাদত বিষয়টি অনেক ব্যাপক যা অনেকের কাছে স্পষ্ট না। অনেকে মনে করে ইস্তেগফার পড়া বা বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাওয়া হলো ভুল বা গুনাহ করলে এই কাজ করতে হয়। কিন্তু তওবা বা ইস্তেগফার করা একটি ইবাদত। গুনাহ তলে বেশি বেশি তওবা করা বা ইস্তেগফার করা ইবাদত।

আল্লাহ তাআলা মানুষের পরস্পর এমন ভালোবাসা সৃষ্টির জন্যও অনেক কিছুকে ইবাদত বানিয়ে দিয়েছেন। কেউ যদি কারও সাথে হাসি মুখে কথা বলে তাহলে তা সদকা করার মতো সওয়াব হয়। এমনই এক ইবাদত হলো রোগী দেখতে যাওয়া বা রোগীর সেবা করা।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ ব্যাপারে খুব তাগিদ ও গুরুত্বারোপ করেছেন। নিজেও রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, এটি একটি মহান ইবাদত। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং তার সেবা-শুশ্রূষা করা, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার ওসিলায় পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধন দৃঢ় হয় এবং পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। হাদিস শরিফের সব গ্রন্থে এর ওপর গুরুত্বারোপ করে বিশদ বিবরণ এসেছে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের পাঁচটি অধিকার রয়েছে ১. সালামের জবাব দেয়া, ২. হাঁচির উত্তর দেয়া, ৩. দাওয়াত কবুল করা, ৪. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও ৫. জানাজায় অংশগ্রহণ করা’ ( বুখারি ১২৪০, মুসলিম ২১৬২)।

অপর বর্ণনায় হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন মহান রাব্বুল আলামিন আদম সন্তানকে সম্বোধন করে বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি। বান্দা বলবে, আপনি তো বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আমি আপনাকে কীভাবে দেখতে যেতে পারি? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তুমি তাকে দেখতে গেলে তার কাছে আমাকে পেতে’ (মুসলিম ২৫৬৯)।

রোগী দেখতে যাওয়ার ফজিলত

রোগীকে দেখতে যাওয়ার অনেক ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সকালবেলা কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায় ৭০ হাজার ফেরেশতা বিকেল পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকেন। আর বিকেলে রোগী দেখতে গেলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয় (আবু দাউদ ৩০৯৮, তিরমিজি ৯৬৯, ইবনে মাজাহ ১৪৪২)।

হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, তাকে জাহান্নাম থেকে ৬০ বছর সমপথ দূরে রাখা হবে’ (আবু দাউদ ৩০৯৭)।

রোগী দেখতে যাওয়ার আদব

১. অজুসহ রোগীকে দেখতে যাওয়া।

২. যথাসম্ভব রোগীর শরীরে হাত দিয়ে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা (মুসনাদে আহমাদ ২২২৩৬)।

৩. রোগীকে সান্ত্বনার বাণী শোনানো। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো রোগীর কাছে যাবে, তার জীবন সম্পর্কে আনন্দদায়ক কথা বলবে, তাকে সান্ত্বনার বাণী শোনাবে।’ এ সান্ত্বনার বাণী ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না, যা ঘটার তাই ঘটবে কিন্তু তার মন সান্ত্বনা লাভ করবে, যা রোগী দেখতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য’ (তিরমিজি-২০৯৪)।

৪. রোগীর কাছে বেশি সময় অবস্থান করবে না। কারণ এতে রোগীর কষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যদি রোগীর পাশে অবস্থান করা অন্তরের প্রশান্তি ও সান্ত্বনার কারণ হয় তাহলে দীর্ঘ সময় অবস্থান করাতে কোনো সমস্যা নেই।

৫. চিকিৎসক কর্তৃক রোগীর সাথে দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে কোনো পরামর্শ থাকলে, তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। অনেক সময় আমরা আবেগতাড়িত হয়ে, এসবের প্রতি তোয়াক্কা না করে, রোগীকে দেখতে যাই। এতে রোগীর উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়।

৬. রোগীর কোনো চাহিদা আছে কি না জিজ্ঞেস করা। খাবার বা অন্য কোনো বৈধ চাহিদা থাকলে যথাসম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করা।

৭. রোগীর কাছে উচ্চ আওয়াজে কথা বলবে না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘সুন্নত হলো রোগীর পাশে কম বসা এবং বড় আওয়াজে কথা না বলা’ (মিশকাত-১৫৮৯)।

৮. রোগীর জন্য দোয়া করা। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমূর্ষু রোগী ছাড়া যেকোনো রোগীর কাছে নিম্নের দোয়াটি সাতবার পাঠ করা হলে, সে রোগী অবশ্যই ওই রোগ থেকে মুক্তি লাভ করবে’ (আবু দাউদ ৩১০৬)।

أَسْأَلُ اللَّهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ
উচ্চারণ : আস আলুল্লাহাল আজিমা রব্বাল আরশিল আজিমি আঁইয়াশফিয়াক।

৯. রোগীর কাছে নিজের জন্য দোয়া চাওয়া। হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন কোনো রোগীকে দেখতে যাবে, তার কাছে দোয়া চাইবে। কারণ তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতো কবুল’ (ইবনে মাজাহ ১৪৪১)।

১০. রোগী মুমূর্ষু হলে তার কাছে সুরা ইয়াসিন পাঠ করা।

১১. অসুস্থ ব্যক্তিকে রোগের অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস না করা। কারণ অনেক সময় এতে রোগী বিব্রতবোধ করে। তবে চিকিৎসকের ব্যাপার ভিন্ন।

Scroll to Top