হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম। নবম হিজরিতে হজের বিধান ফরজ হয়। দশম হিজরিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ আদায় করেন। হজ আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে- ইচ্ছা করা, সফর করা, ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কাজ সম্পাদন করা।
হজে যাওয়ার আগে দরকার প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য একবার হলেও হজ সম্পাদন করা আবশ্যক। হজযাত্রীদের প্রস্তুতি আগেভাগে সেরে নেওয়া উচিত। বিশ্বের নানা প্রান্তের, নানা ভাষার মানুষ হজ পালনের জন্য সৌদি আরব গমন করেন। হজ ও উমরার সময় ব্যবহৃত হয় কিছু আরবি পরিভাষা। এ পরিভাষাগুলো জানা থাকলে হজ পালন সহজ হয়।
ইহরাম: হজ ও ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু কথা ও কাজ নিজের ওপর নিষিদ্ধ করে নেওয়ার সংকল্প করা।
মিকাত: মক্কায় প্রবেশের জন্য চতুর্দিকে নির্দিষ্ট দূরত্বে বিশেষ জায়গাকে সীমারেখা করে খুঁটি পুঁতে রাখা আছে। এদের মিকাত বলা হয়। হজ ও ওমরাকারীদের এই স্থান অতিক্রম করার আগেই ইহরাম বাঁধতে হবে।
তাওয়াফ: প্রদক্ষিণ করা। পবিত্র কাবার চারপাশে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে।
ইজতিবা: ডান বগলের নিচ দিয়ে চাদরের প্রান্ত বাম কাঁধের ওপর উঠিয়ে রাখা। এভাবে ডান কাঁধ খালি রেখে উভয় প্রান্ত বাম কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে রাখা। যে তাওয়াফের পর সায়ি আছে পুরুষের জন্য সে তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করা সুন্নত। আর ওই তাওয়াফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইজতিবা অবস্থায় থাকা পৃথক একটি সুন্নত।
রমল: ঘন পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটা। হজ বা ওমরার প্রথম তাওয়াফের সময় প্রথম তিন চক্কর ডান কাঁধ খোলা রেখে বীরের বেশে দ্রুততার সঙ্গে হাঁটতে হয়, এটাকে রমল বলে।
তাওয়াফে কুদুম: কদুম অর্থ আগমন করা। সুতরাং এর অর্থ আগমনি তাওয়াফ। মিকাতের বাইরের লোকেরা যখন হজ বা ওমরার উদ্দেশ্যে কাবা শরিফে আসেন, তখন তাদের বায়তুল্লাহ তথা কাবার সম্মানার্থে এ তাওয়াফটি করতে হয়- এটি সুন্নত।
তালবিয়া: সাড়া দেওয়া। মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে হজ বা উমরার উদ্দেশ্যে আগমনকারীকে ‘লাব্বায়িকা আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকা ওয়াল মূলক, লা শারিকালাক’ পাঠ করতে হয়।
মাকামে ইবরাহিম: হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর দাঁড়ানোর স্থান। একটি বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবা নির্মাণের কাজ করেন। ওই পাথরে তার পদচিহ্ন পড়ে যায়, যা এখনও বর্তমান। কাবা শরিফের সামনে অবস্থিত এই পাথরকে মাকামে ইবরাহিম বলা হয়।
মাতাফ: তাওয়াফ করার স্থান। কাবা ঘরের চারদিকে সাদা পাথর বিছানো এলাকাকে মাতাফ বলা হয়। এই স্থান দিয়ে তাওয়াফ করা হয়।
মুলতাজিম: পবিত্র কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্বকোণে একখণ্ড বেহেশতি পাথর লাগানো আছে। এখান থেকে কাবাঘরের দরজা পর্যন্ত দেয়ালের অংশটিকে মুলতাজিম বলে। যা দোয়া কবুলের স্থান হিসেবে পরিচিত। তাই এখানে সবসময় লোকজনের ভিড় লেগে থাকে।
হাতিম: কাবা শরিফ সংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম দিকে অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা জায়গাকে ‘হাতিম’ বলে।
মিজাবে রহমত: মিজাব আরবি শব্দ। মিজাব অর্থ হলো নল। হাতিমের মধ্যে একটি পাথরের ওপর পবিত্র কাবাঘরের ছাদের পানি পড়ার জন্য যে স্বর্ণের নল আছে, সেই নলটিকেই মিজাবে রহমত বলে। কখনও বৃষ্টি হলে এই বরকতময় পানি সংগ্রহের জন্য ভিড় জমে যায়।
রুকন: স্তম্ভ, হজের রুকনের অর্থ হজের স্তম্ভগুলো। যার ওপর হজের ভিত্তি। এর কোনোটি বাদ গেলে হজ আদায় হয় না।
রুকনে ইয়ামানি: রুকনে ইয়ামানির অর্থ কাবার সেই স্তম্ভ যেটি ইয়ামান দেশের দিকে স্থাপিত।
হাতিম: কাবাসংলগ্ন উত্তর পাশে খোলা জায়গা, যা হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক নির্মিত মূল কাবার অংশ ছিল।
মাসয়া: সায়ি করার স্থান। সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গা, যেখানে লোকজন সায়ি করে।
সায়ি: দৌঁড়ানো। এখানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার যাওয়া আসা করাকে বোঝায়।
হলক: হজ বা ওমরার কাজ সম্পন্ন হলে মাথার চুল কামাতে বা ছোট করতে হয়। মাথা কামানোকে হলক এবং চুল ছোট করাকে কসর বলা হয়।
কসর: সংক্ষিপ্ত করা। চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজগুলো দুই রাকাত করে আদায় করা।
জাবালে আরাফা: আরাফায় অবস্থিত পাহাড়, যাকে সাধারণ মানুষ জাবালে রহমত বা রহমতের পাহাড় বলে থাকে।
তাওয়াফে জিয়ারা: ১০ জিলহজ কোরবানি ও হলক-কসরের পর থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে কাবা শরিফের তাওয়াফ করাকে তাওয়াফে জিয়ারা বলে। এ তাওয়াফ ফরজ।
আইয়ামে তাশরিক: ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আছর পর্যন্ত পাঁচদিন হলো আইয়ামে তাশরিক। এ দিনগুলোতে প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ তাকবির পাঠ করতে হয়।
এই তাকবিরকে বলা হয় তাকবিরে তাশরিক। তাকবির একবার বলা ওয়াজিব। একবার পাঠ করলেই ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। এ তাকবির নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই পড়তে হয়। জামায়াতে বা একাকী আদায়কৃত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পরেই পড়তে হয় এই তাকবির।
ইয়াওমুত তারবিয়া: জিলহজ মাসের ৮ তারিখ মিনায় যাওয়ার দিন।
ইয়াওমু আরাফা: আরাফা দিবস। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সূর্য হেলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ফরজ হিসেবে আরাফায় অবস্থান করতে হয়। এ দিনকে ইয়াওমু আরাফা বলে।
উকুফ: অবস্থান করা। আরাফা ও মুজদালিফায় অবস্থান করাকে যথাক্রমে উকুফে আরাফা ও উকুফে মুজদালিফা বলা হয়।
জামরা: শাব্দিক অর্থ পাথর। মিনায় অবস্থিত প্রতীকী শয়তানের স্তম্ভকে পাথর মারার স্থান। জামরার সংখ্যা তিনটি।
দম: হজ ও ওমরা আদায়ে ওয়াজিব ছুটে যাওয়া, ভুলত্রুটি হলে তার কাফফারাস্বরূপ একটি পশু জবাই করে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হয়; এই পশু জবাইকে বলে দম দেওয়া।
ফিদিয়া: সাধারণ কোনো অপরাধ হয়ে গেলে তিনটি কাজের যে-কোনো একটি করতে হয়। ছয়জন মিসকিনকে এক কেজি দশ গ্রাম পরিমাণ খাবার প্রদান কিংবা তিন দিন রোজা পালন করা অথবা ছাগল জবাই করে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া।
মাবরুর: হাদিসে কবুল হজকে মাবরুর হজ বলা হয়েছে।
হারাম: নিষিদ্ধ বস্তুকে হারাম বলে। আবার সম্মানিত স্থানকেও হারাম বলে। মক্কা ও মদিনার নির্দিষ্ট সীমারেখাকে হারাম বলে।
হালাল: ইহরাম শেষ হওয়ার পর মুক্ত অবস্থাকে হালাল হওয়া বলে।
রওজা: নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজ মিম্বর ও ঘরের মাঝখানের অংশকে জান্নাতের একটি বাগান বলে অভিহিত করেছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ঘরের মাঝে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
ইফরাদ: শুধু হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই ইহরামেই হজকার্য সম্পন্ন করা।
তামাত্তু: শুধু ওমরাহর নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওমরাহর কাজ সমাপ্ত করে মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া। অতঃপর ওই সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজের কাজ সম্পাদন করা।
কিরান: একসঙ্গে ওমরাহ ও হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই একই ইহরামে ওমরাহ ও হজ পালন করা। এই তিন প্রকারের মধ্যে উত্তম হলো কিরান। কিন্তু ইহরাম দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে নিষেধাজ্ঞাবলি সঠিকভাবে মেনে চলতে না পারার আশঙ্কা থাকলে হজে তামাত্তুই উত্তম। (ফাতাওয়া শামি : ২/৫২৯)