মাহে রমজানে কোরআন তিলাওয়াতে করণীয়

কোরআন নাজিলের মাস রমজান। রমজানে কোরআনের তিলাওয়াতে মুখরিত থাকে মুমিনের জীবন। রমজানে মহানবী (সা.) কোরআনচর্চায় অধিক মনোযোগী হতেন এবং নবীজি (সা.) ও জিবরাইল (আ.) পরস্পরকে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়ই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।

(বুখারি, হাদিস : ৬)
এ জন্য আলেমরা রমজান মাসে কোরআন পাঠের ওপর যেমন তাগিদ দেন, তেমন তা শ্রবণ করাকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যাঁরা সারা দিন তিলাওয়াতের সুযোগ পান না, তাঁরা রমজানের রাতে তারাবিতে কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পারেন।

অন্যের তিলাওয়াত শুনতেন নবীজি (সা.)

আমর ইবনে মুররা (রা.) বলেন, নবী (সা.) আমাকে বললেন, আমার কাছে কোরআন পাঠ কোরো। আমি বললাম, আমি আপনার কাছে পাঠ করব? অথচ আপনার কাছেই তা অবতীর্ণ হয়েছে।

তিনি বললেন, অন্যের মুখ থেকে শুনতে আমি পছন্দ করি। এরপর আমি তাঁর কাছে সুরা ‘নিসা’ পাঠ করলাম, যখন আমি ‘কাইফা ইজা জি’না মিন কুল্লি’ পর্যন্ত (৪১ নম্বর আয়াত) পাঠ করলাম, তিনি বললেন—থাম, থাম, তখন তাঁর দুই চোখ থেকে টপ টপ করে অশ্রু ঝরছিল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৫৮২)
তিলাওয়াত শুনলে সওয়াব হয়

কোরআন তিলাওয়াত শোনা ব্যক্তির জন্য পুণ্যের কাজ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোরআনের কোনো আয়াত শ্রবণ করবে তার একটি সওয়াব—যা বর্ধনশীল লেখা হয়।

আর যে ব্যক্তি কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে তা তার জন্য কিয়ামতের দিন জ্যোতি হবে। (মুসনাদে আহমদ)
তিলাওয়াত শোনার উপকারিতা

পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত শ্রবণ করার বহুবিদ উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে কোরআন ও হাদিসে। নিম্নে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো।

১. অনুগ্রহ লাভ : কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সঙ্গে তা শ্রবণ করবে এবং নিশ্চুপ হয়ে থাকবে।

যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২০৪)


২. আল্লাহর প্রশংসা লাভ : যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা একত্র হয়ে কোরআনের তিলাওয়াত শোনে, তখন তারা আল্লাহর দয়া ও প্রশংসা লাভ করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর কোনো ঘরে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তা নিয়ে আলোচনা করে, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়, তাদেরকে রহমত ঢেকে নেয়, ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের কাছে তাদের প্রশংসা করেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৪৫৫)

৩. হিদায়াত লাভ : কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণের মাধ্যমে ব্যক্তি হিদায়াতের পথে অগ্রসর হয়, হিদায়াত লাভের জন্য তাদের হৃদয় প্রস্তুত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে, যারা মনোযোগসহ কথা শোনে এবং তাদের মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। তাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তারাই বোধশক্তি সম্পন্ন।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ১৭-১৮)

৪. হৃদয়ের অন্ধকার দূর হয় : কোরআন মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অজ্ঞতা দূর করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুশরিকদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তুমি তাকে আশ্রয় দেবে, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। কেননা তারা অজ্ঞ লোক।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৬)

৫. সত্য নির্ণয়ে সাহায্য করে : কোরআন তিলাওয়াত শুনে জিন জাতি সত্য খুঁজে পেয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে, যারা কোরআন পাঠ শুনছিল। যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হলো, তারা বলল—চুপ করে শ্রবণ কোরো। যখন কোরআন পাঠ সমাপ্ত হলো তারা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে। তারা বলছিল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মুসার পরে, এটা তার পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে।’ (সুরা : আহকাফ, আয়াত : ২৯-৩০)

৬. হৃদয়ের কোমলতা সৃষ্টি : পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত শ্রবণ করলে অন্তরে কোমলতা তৈরি হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সংবলিত কিতাব, যা সুসামঞ্জস্য এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। তাতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের গা রোমাঞ্চিত হয়। অতঃপর তাদের দেহমন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।’ (সুরা : ঝুমার, আয়াত : ২৩)

৭. ঈমান বৃদ্ধি : কোরআন তিলাওয়াত শুনলে মুমিনের ঈমান বৃদ্ধি পায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন তো তারাই, যাদের হৃদয় কম্পিত হয়, যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয় এবং যখন তাঁর আয়াত তাদের কাছে পাঠ করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২)

তিলাওয়াত শোনার শিষ্টাচার

পবিত্র কোরআনে তিলাওয়াত শ্রবণ করার শিষ্টাচার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সঙ্গে তা শ্রবণ করবে এবং নিশ্চুপ হয়ে থাকবে। যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ২০৪)

উল্লিখিত আয়াতের আলোকে প্রাজ্ঞ আলেমরা কোরআন তিলাওয়াত শোনার কিছু শিষ্টাচার উল্লেখ করেন। তা হলো—ক. স্থিরতার সঙ্গে তিলাওয়াত শোনা, খ. চুপ থাকা, গ. মনোযোগসহ শোনা। আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছু থেকে মনোযোগ ছিন্ন করা, ঘ. সিজদার আয়াত শুনে সিজদা করা, ঙ. তিলাওয়াতকারী ভুল করলে সংশোধন করে দেওয়া, চ. লৌকিকতায় পূর্ণ তিলাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা।

আল্লাহ সবাইকে যথাযথভাবে কোরআন তিলাওয়াত শোনার তাওফিক দিন। আমিন।

Scroll to Top