মহান আল্লাহ এই উম্মতকে সব উম্মতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, যা তিনি পবিত্র কোরআনেই ইরশাদ করেছেন। সেই হিসাবে শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সব উম্মতই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর হাদিসেও কিছু লোককে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলা হলো, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি।’ সাহাবিরা বলেন, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি; কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, ‘সে হলো পূত-পবিত্র নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ, যার কোনো গুনাহ নেই, দুশমনি, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মঅহমিকা ও কপটতা নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ৪২১৬)
বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী বলতে এখানে মূলত তাদেরই বোঝানো হয়েছে, যারা সহজ-সরল, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, ভদ্র। সহজ নিয়মে বাঁচতে চান, কারো ক্ষতি করেন না। অহংকার নেই, সত্যকে দ্বিধা ছাড়াই গ্রহণ করেন এবং যথাসম্ভব জটিলতা এড়িয়ে চলেন। তারা অতি সাধারণ, সৎ ও খাঁটি। তাদের লুকানো উদ্দেশ্য থাকে না, কোনো দুশমনি থাকে না। মুখে যা বলেন, মনেও তা-ই। তাদের আশেপাশে থাকা নিরাপদ।
তাদেরকেই নবীজি বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী বলে অভিহিত করেছেন এবং সর্বোত্তম মানুষ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি সরল ও ভদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে; কিন্তু পাপিষ্ঠ ব্যক্তি ধোঁকাবাজ ও নির্লজ্জ হয়।’ (আবু দাউদ: ৪৭৯০)
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবো না, কোন ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম হারাম এবং জাহান্নামের জন্য কোন ব্যক্তি হারাম? যে ব্যক্তি মানুষের কাছাকাছি, সহজ-সরল, নম্রভাষী ও সদাচারী।’ (তিরমিজি: ২৪৮৮)
বিশুদ্ধ অন্তরের মানুষগুলো সাধারণত সোজা-সাপ্টা হয়, মানুষ তাদের দুর্বল ভাবে। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের জান্নাতি মানুষের সংবাদ দেব না? আর তারা হলো সরলতার দরুন দুর্বল প্রকৃতির লোক। মানুষ তাদের হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোনো বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। রাসুল (স.) আরো বলেন, আমি কি তোমাদের জাহান্নামিদের সংবাদ দেব না? আর তারা হলো প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী বদমেজাজি ও অহংকারী। ’ (মুসলিম, মেশকাত: ৫১০৬)
সহজ-সরল মানুষগুলো হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকেন। আর হিংসা-বিদ্বেষ না থাকা জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ বের করে ফেলব, তারা সেখানে ভাই ভাই হয়ে আসনে মুখোমুখি বসবে।’ (সুরা হিজর: ৪৭) রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা (সেখানে) একে অন্যের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করবে না। পরস্পর শত্রুতা করবে না। পারস্পরিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবে না।’ তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৬৪২৪)
সহজ-সরল বা বিশুদ্ধ অন্তরের মানুষগুলোর আরেকটি দিক হচ্ছে তারা মানুষের ওপর সহজে রাগ করে না। ক্ষমতাবান হলেও তারা সামান্য ব্যাপারে ক্রোধান্বিত হন না। মানুষের ওপর রাগ না করা ও নিজের রাগ সংবরণ করার ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছুতে নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৯)
প্রিয়নবী (স.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়ার অধিকার দান করবেন।’ (ইবনে মাজাহ: ৪১৮৬)
তাই সম্মানিত সালফে সালেহিনদের মতো মহান মানুষগুলো সরল জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন, ঈর্ষা ও হিংসা থেকে তারা মুক্ত ছিলেন। মানুষকেও সরলতার তাগিদ দিতেন তারা। মূলত সরলতাই বিশুদ্ধতার প্রতীক। সরলতার বিপরীত বিষয় যেমন- হিংসা, লোভ, অহংকার, ঈর্ষা ইত্যাদি মানুষের নেকআমল বরবাদ করে এবং জান্নাতে প্রবেশে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এজন্যই জাহান্নামের শাস্তির পর জান্নাতে প্রবেশ করানোর আগে পাপী মুমিনদের অন্তরকে বিশুদ্ধ করা হবে। রাসুল (স.) বলেন, ‘মুমিনরা যখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক পুলের ওপর তাদের আটকে রাখা হবে। তখন পৃথিবীতে একের প্রতি অন্যের যা যা জুলুম ছিল, তার প্রতিশোধ গ্রহণের পরে যখন তারা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন তাদের জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকে পৃথিবীতে তার আবাসস্থল যেরূপ চিনত, তার চেয়ে বেশি তার জান্নাতের আবাসস্থল চিনতে পারবে।’ (বুখারি: ২৪৪০)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে অন্তরের ব্যাধি থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। সহজ-সরল জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার তাওফিক দান করুন।
আমিন