খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা : আজকাল আমরা গল্পগুজব দিয়ে খাবার খেতে শুরু করি। খাবার টেবিলে বসে হিজিবিজি বকি। খাদ্যের মূল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে স্মরণে আনি না। অথচ আমাদের রাসুল (সা.) খাওয়ার প্রারম্ভে সবসময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাবার শুরু করতেন। তাঁর অন্যান্য সাথীকে খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে উৎসাহিত করতেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে ও ডান হাত দ্বারা খানা খাও এবং তোমার দিক হতে খাও।’ (বোখারি : ৫১৬৭, তিরমিজি : ১৯১৩)।
তিনি শিক্ষা দিয়েছেন খাবার গ্রহণের প্রারম্ভের দোয়া ভুলে গেলে যখন স্মরণ হবে, তখন কী দোয়া পড়তে হবে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা খানা খেতে শুরু করো, তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও, তাহলে বলো ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ও আখিরাহ’। (রিয়াযুস সালেহীন : ৭২৯)।
দস্তরখানায় খাওয়া : সম্প্রতিকালে খাবার সময় দস্তরখানায় খেতে হবে, এটা আমাদের কাছে রূপকথার মতো শুনায়। সেকালে মনে হয়। দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খাওয়া যে কত বড় সুন্নত, তা আমরা ভাবিই না। কিন্তু রাসুল (সা.) খাবারকালে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খেতেন। তিনি এ ব্যাপারে অনেক যতœশীল ছিলেন। এটা অনেক বড় সুন্নত। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার খালাম্মা একবার রাসুল (সা.) এর দরবারে গুইসাপ, কাঁধের গোশত ও দুধ হাদিয়া পাঠালেন। তিনি গুইসাপকে দস্তরখানার ওপর রাখলেন। তিনি এটা খাননি। তিনি দুধ পান করলেন এবং ছাগলের গোশত খেলেন। এ হাদিস দারা বোঝা যায়, রাসুল (সা.) দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খেতেন। অন্য এক হাদিসে আছে, তিনি খাবারগুলো দস্তরখানার ওপর রাখলেন। (তুহফাতুল ক্বারি : ১০/৩৫৬)।
ডান হাত দ্বারা খাবার খাওয়া : ফ্যাশনের ধূম্রজালে আবদ্ধ আর আধুনিকতায় অন্ধ হয়ে আমরা হারাচ্ছি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের ধর্মীয় চেতনা, ধর্মীয় সংস্কৃতি। আজ আমরা বাম হাতে আচ্ছামতো খাবার গ্রহণে রত। কোনো ধরনের তোয়াক্কা নেই। অথচ বাম হাতে খাবার গ্রহণ কোনো সভ্য মানুষের ধাতে ধরবে না। রাসুল (সা.) আমৃত্যু ডান হাত দ্বারা খাবার খেয়েছেন। বাম হাত দ্বারা খাবার খেতে মানুষকে নিষেধ করেছেন। আবদুুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বাম হাত দ্বারা খাবার খেয়ো না ও পান করো না। কেননা শয়তান বাম হাতে খায় ও পান করে।’ (তিরমিজি : ১৯১২)।
নিজের দিক থেকে খাওয়া : রাসুল (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে খানা খেলে সবসময় নিজের দিক থেকে খাবার খেতেন। সাহাবিদের এ মহৎ শিক্ষা দিয়েছেন। ওমর ইবনে আবু সালামাহ বলেন, ‘একদিন আমি রাসুল (সা.) এর সঙ্গে খানা খাচ্ছিলাম। আমি বাসনের বিভিন্ন দিক থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছিলাম। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার দিক থেকে খাও।’ (বোখারি : ৫১৬৮)।
অন্য এক হাদিসে বিধৃত হয়েছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) ডান দিক থেকে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন ডান দিক থেকে জামা পরিধান করা ও তেল ব্যবহার করা।’ (বোখারি : ৫১৭১)।
হাত চেটে খাওয়া : রাসুল (সা.) আহারকালে সবসময় হাত চেটে খেতেন। না চাটা পর্যন্ত কখনও হাত মুছতেন না। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করবে, তখন হাত চাটা নাগাদ তোমরা হাত মুছবে না।’ (বোখারি : ৫২৪৫)।
আঙুল চেটে খাওয়া : আঙুল চেটে খাওয়ার ফলে বরকত লাভের অধিক সম্ভাবনা থাকে। কারণ খাবারের বরকত কোথায় রয়েছে মানুষ তা জানে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করো, তখন আঙুল চেটে খাও। কেননা বরকত কোথায় রয়েছে তা তোমরা জান না।’ (ইবনে মাজাহ : ১৯১৪)।
খাবার তুলে খাওয়া : খাবার গ্রহণের সময় দেখা যায় অনেকের থালা-বাসন থেকে খাবারের লোকমা বা এক-দুই টুকরা ভাত রুটি কিংবা অন্যসব খাবার পড়ে যায়। পতিত খাবারটা আমরা উত্তোলন করি না। গ্রহণ করি না। অথচ ইসলাম বলে, পড়ে যাওয়া খাবার উত্তোলন করো ও খাও। রাসুল (সা.) খাবারকালে যদি কোনো খাবার পড়ে যেত তাহলে তিনি তুলে খেতেন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের খাবার আহারকালে যদি লোকমা পড়ে যায়, তাহলে ময়লা ফেলে তা ভক্ষণ করো। শয়তানের জন্য ফেলে রেখো না।’ (তিরমিজি : ১৯১৫; ইবনে মাজাহ : ৩৪০৩)।
হেলান দিয়ে না খাওয়া : কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে খাবার খেতে তিনি নিষেধ করেছেন। হেলান দিয়ে খাবারের ফলে পেট বড় হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, এটা দাম্ভিকতার আলামত। আবু হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.) এর দরবারে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বলেন, ‘আমি ঠেক লাগানো অবস্থায় কোনো কিছু ভক্ষণ করি না।’ (বোখারি : ৫১৯০; তিরমিজি : ১৯৮৬)। তবে যদি কারও সমস্যা থাকে তাহলে হেলান দিয়ে আহারে কোনো বাধা নেই।
দোষত্রুটি না ধরা : আমাদের অনেককে দেখা যায় খাবারের মাঝে নানারূপ দোষত্রুটি ধরতে। এ নিয়ে আমাদের পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে দেদার। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদের মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। অথচ রাসুল (সা.) এর পুরো জিন্দেগিতে কখনও খাবারের দোষ ধরতেন না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) কখনও খাবারের দোষত্রুটি ধরতেন না। তাঁর পছন্দ হলে খেতেন আর অপছন্দ হলে পরিত্যাগ করতেন।’ (বোখারি : ৫১৯৮; ইবনে মাজাহ : ৩৩৮২)।
স্বর্ণ-রৌপ্যের থালাবাসনে না খাওয়া : রাসুল (সা.) মুসলমানদের স্বর্ণ-রৌপ্যের থালাবাসনে খানা খেতে নিষেধ করেছেন। কেননা এটা অহমিকা ও দাম্ভিকতার নিদর্শন। হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা রেশমি কাপড় পরিধান করো না এবং স্বর্ণ-রৌপ্যের থালায় ভক্ষণ করো না। এ নেয়ামতগুলো দুনিয়ায় কাফেরদের জন্য। আর তোমাদের জন্য আখেরাতে।’ (বোখারি : ৫২১৫)।
খাবারে ফুঁ না দেয়া : খাবারের মধ্যে ফুঁ দেয়া অনেক রোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাসুল (সা.) খাবারে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) কখনও খাবারে ফুঁ দিতেন না। ফুঁ দিতেন না কোনো কিছু পানকালেও।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৪১৩)।
খাবারের শেষে দোয়া পড়া : অনুগ্রহকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা সভ্য মানুষের কাজ। আল্লাহ আমাদের প্রতি খাবারের মাধ্যমে অনেক বড় দয়া-অনুগ্রহ করছেন। এ দয়ার শুকরিয়াস্বরূপ তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করা সভ্যতার লক্ষণ। খাবার খাওয়া শেষ হলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা অপরিহার্য। রাসুল (সা.) খাবার শেষে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাতেন। দোয়া পড়তেন। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) খাবার শেষ করে বলতেন ‘আলহামদুলিল্লাহ কাশিরান ত্বয়্যিবান মোবারাকান ফিহি, গায়র মাকফিই, ওলা মুয়াদ্দায়ি ওলা মুসতাগনা আনহু রাব্বানা।’ তিনি কখনও এ দোয়া পড়তেন‘আলহামদুলিল্লাহ হিল্লাজি আতআমানা ওয়াসাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমিন।’ (বোখারি : ৫৪৫৮)।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, ৩০ অক্টোবর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/কেএসপি