চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলমানদের অবদান

মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূচনা। মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তাগিদে জন্ম থেকেই চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মানুষের ভালো ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে শারীরিক সুস্থতার ওপর। মন ফুরফুরে থাকার মধ্যে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিকায়ন এবং উদ্ভাবিত তত্ত্বসমূহের বাস্তব প্রয়ােগ করে মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ এ শাস্ত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। পৃথিবীর প্রাথমিক দিকে মানুষের মধ্যে চিকিৎসার ধারণা ততটা প্রবল ছিল না। কুরআন মজিদে মানুষের অসুস্থতা ও সেবা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের পর মুসলিমগণ এ বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেন।

ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও চিকিৎসাশাস্ত্রে রেখে যান যুগান্তকারী অবদান। তাঁর হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্রে পূর্ণতা ও সজীবতা আসে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। তাঁর ওপর নাজিলকৃত কোরআন চিকিৎসাশাস্ত্রের আকরগ্রন্থ। মায়ের পেটের ভেতর বাচ্চার ধরন ও ধারণের কথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছে পবিত্র কোরআন। কোরআন জগতের বিস্ময়। চিকিৎসাশাস্ত্রে কোরআনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে জার্মান পণ্ডিত ড. কার্ল অপিতজি তাঁর ‘Die Midizin Im Koran’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট। ৩৫৫টি আয়াতে মানবদেহের সব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া হয়েছে।

রোগের সুস্থতার জন্য মানুষের হাত ধরে আসে লতা-পাতা ও গাছগাছড়ার ব্যবহার। গাছের পাতা, গাছের গোটা ও ফলে খুঁজে পায় সুস্থতার নিরাময়। আজ পর্যন্ত পৃথিবীপাড়ার অলিগলিতে বনজ বা গাছগাছালির সাহায্যে চিকিৎসা অব্যাহত আছে। রাসুলুল্লাহ (স) তাঁর বাণীতে বিভিন্ন ভেষজ ও প্রাকৃতিক বিষয় দিয়ে চিকিৎসার নির্দেশনা দেন। পরবর্তীতে রাসুলের (স) চিকিৎসাবিষয়ক এ বাণীই মুসলিমদের পথপরিক্রমার পাথেয় হয়।

মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে আবু বকর আল- রাযি, ইবনে সিনা, আল-যাহরাবি, হাসান ইবনে হায়সাম, আল-তাবারি, ইবনে আল-নাফিস, ইবনে আল-আব্বাস, ইবনে ঈসা, ইবনে রুশদ, আবুল কাসিম প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিচে শিশু চিকিৎসার জনক আবু বকর আল- রাযি এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনাকে নিয়ে আলোচনা করা হলো:

আবু বকর আল-রাযি

খ্যাতনামা মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ ও দার্শনিক আবু বকর আল-রাযি ৮৬৪ খ্রি. ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রায় ৩৫ বছর ইরানের রয়েল হাসপাতাল এবং বাগদাদের মুক্তাদারি হাসপাতালে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং ওষুধ তৈরি করেন। আল-রাযি রােগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি তখনও পর্যন্ত ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি এমন রােগ নিয়েও গবেষণা করেন। তিনিই প্রথম বসন্ত ও হাম রোগের প্রকৃতি, সংক্রমণ ও নিরাময় নিয়ে গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার লেখা ‘আল-জুদারী ওয়াল হাসবাহ’ ছিল অত্যন্ত মৌলিক গ্রন্থ। এ গ্রন্থের আগে কোনো সভ্যতার লােকদেরই এ সম্পর্কে কোনাে ধারণা ছিল না। আল-রাযি মূত্রনালি ও কিডনির পাথর রোগ সম্পর্কেও প্রাথমিক আলোচনা করেন। তিনি সার্জারি বা শল্য চিকিৎসায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। আল-রাযি হাম, শিশু চিকিৎসা, নিউরোসাইকিয়াট্রিক প্রভৃতি সম্পর্কে নতুন মতবাদ দেন। তিনিই শিশুরোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এজন্য আবু বকর আল-রাযিকে শিশু চিকিৎসার জনক (Father of Paediatrics) বলা হয়।

ইবনে সিনা

আবু আলী ইবনে সিনা হলেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক। তিনি আদিম পদ্ধতির চিকিৎসার পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতি চালু করেন। সেজন্য তাকে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র, চিকিৎসাপ্রণালি এবং শল্য চিকিৎসার দিশারী মনে করা হয়। ইবনে সিনা ওষুধ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ওষুধ তৈরি, সংরক্ষণ ও তা প্রয়ােগের আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবক তিনি। এজন্য ইউরোপীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাকে ‘Master of Medicine’ বলেছেন। ইবনে সিনা প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপােক্রেটিস (Hippocrates) ও গ্যালেনের (Galen) রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ চিকিৎসাশাস্ত্রের পূর্ণতা বিধান করেন। মধ্যযুগে যক্ষ্মা মহামারি আকার ধারণ করেছিল। ইবনে সিনাই প্রথম ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি। মাটি ও পানির মাধ্যমে এটি বিস্তার লাভ করে। যক্ষ্মা বিষয়ে ইবনে সিনার গবেষণা ছিল অত্যন্ত আধুনিক। চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর ইবনে সিনা বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে ‘কানুন ফিত তিব’। তিনি এ গ্রন্থে ৭৬০টি ওষুধের বর্ণনা এবং চিকিৎসাপদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। ইবনে সিনা এটি ছাড়াও ‘কিতাবুস শিফা’ নামে ১৮ খণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি বিভিন্ন রোগের উপসর্গ ও সেগুলাের নিরাময় পদ্ধতি সম্পর্কে বিবরণ দেন। কিতাবুল মুরাদ, কিতাবুল নাযাত, কিতাবুল কুলনজ ইবনে সিনার অন্যতম গ্রন্থ।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমনই গৌরবময় ইতিহাস আছে মুসলমানদের। কিন্তু দুঃখজনকভাবে চতুর্দশ শতকে মুসলমানদের ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ সব কিছু থেকে আধিপত্য কমতে থাকে। চুরি হয়ে যায় অনেক থিওরি। ১৩০০ শতকে মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রগুলোতে চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল সেনারা ৩০ বছর ধরে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে অসংখ্য গ্রন্থাগার ও পুস্তাকালয় বিনষ্ট হয়। আজ যদি মুসলমানদের আবিষ্কার, থিওরি ও লিখিত গ্রন্থাদি থাকত, তাহলে বিশ্ব পেত সভ্যতার চূড়ান্ত পাঠ ও আশাতীত কিছু উদ্ভাবন। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ পেত অভূতপূর্ব আরশি।