বর্তমানে ‘করোনা’ এক আতঙ্কের নাম। এটি কেড়ে নিয়েছে অসংখ্যা মানুষের জীবন আর অধিকাংশ মানুষকে করেছে গৃহবন্দি ও বিপদগ্রস্থ।
এর প্রতিষেধক কিংবা যথাযথ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে পুরো বিশ্বের গবেষকগণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে অদ্যাবধি এটির কোন স্বীকৃত ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। ঠিক এমন সময়ে অনেকেই সুসংবাদ দিল যে, ১২ মে,২০২০ খৃ. এর পরে ‘করোনা’ নামক মহামারি পৃথিবীতে আর থাকবে না। এ সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়েছে।
তাঁরা বলেন, হাদিস শরিফে রয়েছে যে, ‘সুরাইয়া’ নামক তারকা উদিত হলে জনপদের মুসিবত বা ব্যাধি নির্মূল হয়ে যাবে। সুতরাং ১২ মে ‘সুরাইয়া’তারকা উদিত হবে। ফলে বিশ্ববাসির ‘করোনা’ নামক মুসিবতটি বিদায় নিবে। আসলে ব্যাপার কি তাই?
•আসুন দেখে নিইঃ-
১.রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-إذَا طَلَعَ النَّجْمُ رُفِعَتْ الْعَاهَةُ عن أَهْلِ كل بَلَدٍ “তারকাটি উদিত হলে প্রত্যেক দেশ থেকে বালা মুসিবত উঠিয়ে নেওয়া হবে।” [ইমাম তাহাভি, শারহু মুশকিলিল আছার,হা.নং-২২৮২]
২.তিনি আরো ইরশাদ করেন- مَا طَلَعَ النَّجْمُ صَبَاحًا قَطُّ، وَتَقُومُ عَاهَةٌ، إِلَّا رُفِعَتْ عَنْهُمْ أَوْ خَفَّتْ “তারকাটি প্রত্যুষে উদিত হলেই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান বালা মুসিবত তুলে নেওয়া হবে কিংবা হ্রাস করা হবে।” [মুসনাদে ইমাম আহমদ, হাদিস নং-৯০৩৯]
•এভাবে আরো হাদিস শরিফ বর্ণিত রয়েছে। এসব হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, তারকাটি উদিত হলে, বিদ্যমান বালা মুসিবত থাকবে না বা হ্রাস পাবে। হাদিস ভাষ্যকারদের মতে, এখানে ‘তারকা’ বলতে ‘সুরাইয়া’ তারকাকে বোঝানো হয়েছে। কারণ অন্যান্য হাদিসে সরাসরি ‘সুরাইয়া’ শব্দটি এসেছে। আর হাদিসে বর্ণিত বালা মুসিবতের ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের দু’টি অভিমত রয়েছে।
১.প্রথমত বিশেষ করে খেজুরের মুসিবত অর্থাৎ রোগ বালাই ও অপরিপক্কতা।
২.দ্বিতীয়ত সামগ্রিক মুসিবত বা রোগ তথা মানুষ, প্রাণি ও ফসলাদির বালা মুসিবত।
•প্রথম অভিমত: অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের মতে, হাদিস শরিফটি খাছ বা নির্দিষ্ট অর্থবোধক। এ কারণে বালা মুসিবত বলতে, ফল-ফলাদি বিশেষকরে খেজুরের রোগ বালাই ও অপরিপক্বতাকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, আব্দুল্লাহ্ ইবন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা আমাদেরকে ফলের মুসিবত বা ব্যাধি দূর না হওয়া পর্যন্ত ফল-ফলাদি বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। হযরত উসমান ইবন আব্দিল্লাহ হযরত ইবন উমারকে জিজ্ঞেস করলেন, কখন ফলের মুসিবত দূর হবে? তিনি বলেন, ‘সুরাইয়া’ তারকা উদিত হলে।’[তাহাভি, শারহু মুশকিলিল আছার, হা.নং- ২২৮৩]
অন্য হাদিসে রয়েছে, ইবন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ক্রেতা ও বিক্রেতাকে খেজুর পরিপক্ক ও মুসিবতমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।”[মুসনাদে আহমাদ, হা.নং-4493]
হাদিস ভাষ্যকারদের মতে,বিশেষকরে হিজায তথা আরবে ‘সুরাইয়া’তারকা দৃশ্যমান হতো ফল-ফলাদি বা খেজুর তুলে নেওয়ার উপযুক্ত সময়ে। এটির উদয়টা ফল-ফলাদি কিংবা খেজুর পরিপক্ক হওয়ার সংকেত বহন করে। সুতরাং ফল-ফলাদি বিক্রয়ের জন্যেও তা উপযুক্ত সময়। তবে এর অর্থ এটা নয় যে, এটির কারণে ফল-ফলাদি বা ফসল নিরাপদ হয়। এক কথায়, এটি উদিত হওয়ার সময়টি সার্বিকভাবে ফসল বিশেষ করে খেজুরের জন্যে নিরাপদ সময়কে ইঙ্গিত করে। আরবের খেজুর তথা ফল-ফলাদির ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। [মুল্লা আলি কারি, শারহু মুসনাদে আবি হানিফা,পৃ.১৪১-৪২, তাহাভি, শারহু মুশকিলিল আছার, খ.৬, পৃ. ৫৪, ইবন হাজর আসকালানি, ফতহুল বারি, খ.4, পৃ.395; অন্যান্য ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ]
•দ্বিতীয় অভিমত: আল্লামা সামআনি, মুনাভি প্রমুখের মতে, হাদিস শরিফটি ‘আম’ বা বিস্তৃত অর্থবোধক। তাই মুসিবত বলতে সাধারণভাবেই বালা মুসিবতকে বোঝানো হয়েছে। এ কারণে সুরাইয়া উদিত হলে সব রকমের বালা মুসিবত যেমন মহামারি ইত্যাদি হ্রাস বা নির্মূল হয়ে যাবে।[মুনাভি, ফয়দুল কদির শরহুল জামিয়িছ্ ছগির, খ.৫, পৃ.৪৫৪; সামআনি, তাফসিরুল কুরআন, খ.৬, পৃ.৩০৬]
এ দুটি ব্যাখ্যার মধ্যে প্রথম ব্যাখ্যাটি যদি রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা\’র উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ‘সুরাইয়া’ উদিত হলেও, করোনা নামক মহামারিটি হ্রাস বা নির্মূল হওয়ার মধ্যে কোন প্রভাব পড়বে না। আর যদি দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা\’র উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অবশ্যই এটি মানবজাতির জন্যে সুসংবাদ। ফলে সুরাইয়া উদিত হলে করোনা হ্রাস কিংবা নির্মূল হয়ে যাবে। তবে ১২ মে করোনা নির্মূল হবে- ১০০% গ্যারাণ্টি দিয়ে কথাটি এ সময়ে প্রচার করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ,হাদিস শরিফের উদ্দেশ্য প্রথমটি না দ্বিতীয়টি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তবে অসীম দয়াবানের নিকট কামনা করি যেন তিনি দ্রুতই তা নির্মূল করে দেন।
→আকিদা: সুরাইয়া তারকা মুসিবত বা ব্যাধি নির্মূলকারী বা হ্রাসকারী নয়; বরং আলামত মাত্র। প্রকৃত মুসিবত বা ব্যাধি নির্মূলকারী হলেন আল্লাহ তায়ালা।
মাওলানা রবিউল আলম।
:ফেসবুক থেকে সংগৃহীত