জহুরা আকসা
হ্যাঁ ভাই, আমরা প্রবাসে বসে জুতা পালিশ করি। কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুল বেচি, কখনো বা খাবার। অনেক প্রবাসী শ্রমিকের কাজও করে। এই আমাদের ইউরো, ডলার আর রিয়ালের টাকায় ‘আপনাদের’ দেশ চলে। হ্যাঁ, আপনাদের দেশ বললাম। কারণ আপনাদের মতো কিছু কুলাঙ্গার আছে যারা এই প্রবাসীদের দেশের কথা ভাবতে মানা করে! দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে তাচ্ছিল্য করে!
শোনেন ভাই, দেশটা আমাদেরও। তাই দেশের কথা বলবো। একশ বার বলবো। হাজার বার বলবো। আপনাদের ভালো না লাগলেও বলবো। বলতে আমাদের হবেই। দেশটা তো আমাদেরও, তাই না!
জানেন ভাই, এই যে আমরা যারা উন্নত বিশ্বে জুতা পালিশ করি, এই আমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়ে? বিশ্বের যত নামকরা স্কুল-কলেজে! না ভাই, এর জন্য আমাদের টাকা দিতে হয় না। না কোনো ডোনেশন। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও আমাদের দেশটাতে বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি!
এই আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন বিদেশের মাটিতে এমপি মিনিস্টার হয়, যখন অলিম্পিকের গোল্ড মেডেল জিতে, যখন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পায়, তখন আপনারাই গর্বিত হোন। আপনাদের সংবাদপত্রে আমাদের সন্তানদের বাংলাদেশী বলে আপনারাই প্রচার করেন।
জানেন ভাই, আমরা অসুস্থ হলে কোথায় চিকিৎসা করি? আপনাদের হাজার’টা এ্যাপোলো আর ল্যাব এইডের চিকিৎসার চাইতে আরো উন্নত আর আধুনিক হাসপাতালে। জানেন, এইখানে আমাদের টাকা দিতে হয় না! শুধু তাই না, ডাক্তারদের পিছনে দৌড়াতে হয় না!
জানেন ভাই, এই দেশের ডাক্তাররা খুবই গাধা। গুরুতর অসুস্থ রুগীদের ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়! এখানেও শেষ নয়, প্রতি সপ্তাহে রোগীর অবস্থার অাপডেট ফলোআপ করে, তাও ইন্টারনেটে!
বাংলাদেশ তো এখন ডিজিটাল, তাই না? কই ভাই, এমন তো কোনো হাসপাতাল পাইনি, যেখানে রোগীর এইরকম উন্নত চিকিৎসা হয়! তাও ফ্রিতে! এই তো সেদিন একজন প্রসূতি মা টাকার অভাবে হাসপাতালের সামনের গাছ তলায় বাচ্চা প্রসব করলেন। প্রায়ই তো দেখি, হাসপাতালের বিলের জন্য মৃত রুগীর লাশও আপনারা আটকে রাখেন!
থামেন ভাই। আমাদের দেশপ্রেম আছে। ১৬ কোটি জনগণের সকল সুযোগ সুবিধা কি আমাদের ঐ ছোট দেশটি দিতে পারে? তাই তো দেশের বোঝা কমাতেই আমরা বিদেশে আসছি। দেশকে কিছু দিতে চাই। চাই বলেই বেতনের টাকাটা হাতে পেয়েই দেশে পাঠিয়ে দিই। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখি।
হ্যাঁ ভাই, আমরা জুতা পালিশ করি। দেশ আমাদের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাই তো বিদেশে এসে জুতা পালিশ করি। তাতে কী? বৃদ্ধ বয়সে আমাদের পেনশনের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় না। আমাদের ন্যুনতম সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ার জন্য এইসব দেশের সরকার আছে, আছে বিভিন্ন সংস্থা! আজও আপনারা বৃদ্ধদের নিরাপত্তা দিতে পারেননি। পারেননি তাদের সম্মান দিতে। দিবেন কী করে? আপনাদের চোখে তো গ্ল্যামার ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না।
ভাই, আপনি আমাদের কাজের চর্চা না করে, বরং গ্রামে গিয়ে ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। ফালতু কথায় চায়ের কাপে ঝড় না তুলে বরং দেশকে কিছু দেন। দেখে আসেন তারা কতো কষ্ট করে আমাদের অন্ন যোগায়!
দুইশত বছরের ব্রিটিশদের গোলামি আপনাদের রক্তে মিশে গেছে। তাই তো এতো শ্রেণি বিভেদ করেন। দেশের চাষীদের তো আপনাদের ক্ষেত, মূর্খ চাষাভুষো ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। তাই তো জুতা পালিশও আপনাদের কাছে ঘৃণিত পেশা।
এই আপনাদের মতো লোকেদের শ্রেণি বিভেদের কারণেই দেশেটা আজ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। সবাই দ্রুত বড় লোক হতে চায়। কেউ চাষাভুষো গালিগালাজ খেতে চায় না।
হ্যাঁ ভাই, আমরা জুতা পালিশ করি। সৎভাবে জীবিকা অর্জন করি। ঘুষ খাই না। দুর্নীতি করি না। দেশের বোঝাও হইনি। বরং দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করেছি।
হ্যাঁ ভাই, আমরা জুতা পালিশ করি!
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ