স্পেনে দ্বিতীয় তরঙ্গ সংক্রমণ : হাজারো বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ফের শুরু হয়েছে স্পেনে, এতে হাজারেরও অধিক প্রবাসী বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা দেশ স্পেন নতুন করে আবারও করোনাভাইরাসের কবলে পড়তে যাচ্ছে। গেল দুই সপ্তাহে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা করোনার ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ বা ‘দ্বিতীয় ধাপ’ এর আশঙ্কা করছেন। স্পেনের আঞ্চলিক সরকারগুলো করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পৃথকভাবে নানা বিধিনিষেধ জারি করেছে। করোনার দ্বিতীয় ধাপে দেশটিতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবলে ইউরোপের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ স্পেন। গত ১৪ মার্চ থেকে ২১ জুন পর্যন্ত লকডাউনের আওতায় ছিল দেশটি। পরবর্তীতে মাসখানেক পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকার পর আবারও নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকে। গত দুই সপ্তাহে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘দ্বিতীয় তরঙ্গ’ এর আশঙ্কাকরছেন দেশটির সরকার। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন সতর্কতামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে দেশটির সরকার। ইতিমধ্যে মাদ্রিদ আঞ্চলিক সরকারের পক্ষ থেকে করোনায় বেশি সংক্রমিত মাদ্রিদের ৩৭টি এলাকাতে লকডাউনের আদলে নানা বিধিনিষেধ জারি করেছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিরাও নতুন করে করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে গত মহামারির সময় এত সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি আক্রান্ত হননি। বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থা ‘ভালিয়ান্তে বাংলা’ দাবি করেছে তাদের তথ্য মোতাবেক – এখন পর্যন্ত পুরো স্পেনে এক হাজারের ওপর প্রবাসী বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন কিংবা নিজ গৃহে আইসোলেশনে আছেন।
এরই মধ্যে দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ৪৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশি শঙ্কটাপন্ন অবস্থায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন বলেও জানিয়েছেন ‘ভালিয়ান্তে বাংলা’র সভাপতি মো. ফজলে এলাহী, যিনি নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নিজ ঘরে আইসোলেশনে আছেন। স্পেনে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে নিজেদের সচেতনতাকেই দায়ী করেছেন কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন স্পেনের সভাপতি কাজী এনায়েতুল করিম তারেক বলেন, ‘করোনা বিষয়ে স্পেন সরকার প্রদত্ত নিয়ম কানুন আমাদের মেনে চলা উচিত। কখনোই করোনার উপসর্গকে হালকাভাবে দেখা যাবে না। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা উচিৎ, চিকিৎসক যদি ঘরে থাকতে বলে, তবে নিজ ঘরেই থাকা উচিত।’ বাংলাদেশি কোনো ব্যবসায়ী যদি করোনা আক্রান্তদের কাজে যেতে বাধ্য করেন, তবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনকে তিনি জানানোর অনুরোধ জানান। তিনি আরও জানান এ ব্যাপারটি কমিউনিটির স্বার্থে অ্যাসোসিয়েশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

মাদ্রিদের ‘ভালিয়ান্তে বাংলা’র সভাপতি মো. ফজলে এলাহী বলেন, ‘আমরা সচেতন নই, করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেককেই ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। অনেকেই করোনার উপসর্গ নিয়ে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কাজে যোগ দিচ্ছেন। এতে করে তিনি অনেককেই সংক্রমিত করছেন। তাছাড়া আমাদের কাছে এমনও অভিযোগ এসেছে যে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক তার কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত জেনেও কাজে যেতে বাধ্য করছেন এই বলে যে, তিনি না আসলে আরেকজনকে কাজে নিয়ে নেবেন।’ মো. ফজলে এলাহী আরো বলেন, দেখা গেছে কর্মচারী সুস্থ থাকলেও তিনি যে বাসায় থাকেন, সেখানকার এক বা একাধিকলোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ পর্যায়ে তার বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকা উচিত অথচ কাজ টিকিয়ে রাখতে তিনি কাজে যোগ দিচ্ছেন। ফলে একসময় তিনিও আক্রান্ত হচ্ছেন এবং অন্য সহকর্মীদের মাঝেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।’

স্পেন বাংলা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যাচেলররা সাধারণত মেস করে থাকেন। দেখা গেল মেসের কেউ একজন করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, কিন্তু তিনি উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও মেসের সদস্যদের বিষয়টা জানাচ্ছেন না বা লুকিয়ে রাখছেন। মেসের অন্যান্য সদস্যরাও এতে করে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর পাশাপাশি তারা যখন বাইরে বের হচ্ছেন, তখন বাইরের মানুষের মাঝেও ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমাদের কমিউনিটিতে আসলে নিজেদের সচেতনতা ছাড়া করোনার সংক্রমণ থামানো যাবে না।’

এদিকে জানা গেছে, স্পেনের বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মচারির করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ায় দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। ৬ সেপ্টেম্বর এরই পরিপ্রেক্ষিতে দূতাবাস এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে দূতাবাসের কনস্যুলার সার্ভিস সাময়িক বন্ধের ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ১৭ সেপ্টেম্বর আরেকটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, একটি নির্দিষ্ট নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ পাঠিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার মাধ্যমে দূতাবাসের কনস্যুলার সার্ভিস চলমান থাকবে।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক জরিপকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুসারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিবেচনায় ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে স্পেন। দেশটিতে ছয় লাখ ৫৯ হাজারের অধিক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৩০ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন।

Scroll to Top