বাংলাদেশে নিরাপদ আর আরামদায়ক যাত্রার জন্য ট্রেনের বিকল্প নেই। সব বয়সী যাত্রীদের প্রথম পছন্দ ট্রেন। ট্রেনের এই জনপ্রিয়তার আড়ালে লুকিয়ে আছে অগ্নিঝুঁকি। তার অন্যতম কারণ হলো দেশের বিভিন্ন পথে চলাচল করা ট্রেনগুলোর অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নেই। যেগুলো আছে তাতে হয়ত মেয়াদ নেই অথবা অকেজো। কমলাপুরের রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা আন্তঃনগরসহ প্রায় সব ট্রেনই অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রগুলো কামরার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায় চিলাহটি থেকে ছেড়ে আসা নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি দাঁড়িয়ে ছিল রাজধানীর কমলাপুরের ৬নং প্লাটফর্মে। আমরা প্রতিনিধি বলেন ট্রেনটির ১২টি কামরা ঘুরে একটিতেও সচল অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেগুলো আছে তার অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এছাড়া কয়েকটি যন্ত্র জায়গা থেকে হারিয়ে গেছে। ট্রেনটির একটি কামরার গাইড হিসেবে কাজ করেন রফিকুল। তিনি আমাদের প্রতিনিধিকে জানান, ‘এগুলো সব ঠিক ছিল এবং মেয়াদ এখনো আছে। এগুলো অকেজো হওয়ার কারণ উৎসুক জনতা। ট্রেনের কিছু যাত্রী আছে যারা অতি উৎসাহী হয়ে কারণ ছাড়াই এগুলো নষ্ট করে ফেলে।’
নীলফামরির ডোমারের পথে যাওয়া এক যাত্রীর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘দেশের যে কোনো বাহনের চেয়ে ট্রেন সবচেয়ে নিরাপদ। তবে আগুন লাগলে অনেক বড় দুর্ঘটানা ঘটে যেতে পারে। আগুন নেভানোর মতই কিছুই পাওয়া যাবে না। এটা যদি চলন্ত অবস্থায় হয় তবে বিপদ আরো বেশি হবে’।
এমন চিত্র পাওয়া যায় দ্রুতযান, চিত্রা, সিল্কসিটি, সুন্দরবন, সুবর্ণ, পরবত, রংপুর এক্সপ্রেসে। এর কোনো ট্রেনেই অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা চোখে পরে নাই। তবে ট্রেনগুলোতে যে কোনো এক সময় অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এর রাখার স্থান দেখে। প্রতিটি কামরায় দুটি করে অগ্নি নির্বাপক সিলিন্ডার রাখার জায়গা রয়েছে। এ বিষয়ে রেলের এক কর্মকর্তা আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, ‘কামরায় অগ্নি নির্বাপক সচল না থাকার অন্যতম কারণ ব্যবস্থাপনার অভাব। যারা এই দায়িত্বে আছেন তারা উদাসীন। যতদিন পর্যন্ত না একটা দুর্ঘটনা ঘটবে ততদিন পর্যন্ত তাদের টনক নড়বে না’।
এর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা কালনী এক্সপেসে আগুন লাগে। এতে হতাহত না হলেও ট্রেনটির তিনটি বগি পুড়ে যায়। তবে সেই আগুনে হতাহত না হওয়ার বিষয়ে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্রেনটির গতি ছিল খুব কম আর ঢাকার ভিতরে হওয়ার কারণে আগুন খুব দ্রুত নিভিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। তবে এই ঘটনাটি দুর্গম কোনো এলাকায় ঘটলে ক্ষয় ক্ষতি আরো বেশি হত’।
পরবর্তীতে রেলওয়ে তদন্তে জানা যায় খাবারের গাড়িতে থাকা চুলার আগুন থেকে এই আগুন সূত্রপাত ঘটে। এরপর থেকেই খাবারের গাড়িতে আগুনের চুলার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে এর পরেও বড় ধরনের আগুন লাগার ঘটনা না ঘটলেও একাধিক ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এতে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। সেই ট্রেনগুলিতে কী কারণে আগুন লাগে তার সঠিক প্রতিবেদন রেলওয়ে থেকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মেকানিক বিভাগের উপ-পরিচালক সুজিদ মজুমদার আমাদের প্রতিনিধি আলামিনকে বলেন, অগ্নি নির্বাপকের বিষয়ে একক কোনো প্রতিবেদন না থাকলেও অন্যান্য বিষয়ের সাথে আছে। এটা তদারকি করার দায়িত্ব বিভাগিয় প্রকৌশলীদের।’
তবে বিষয়টি জানার পর তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেন নাই।
এ বিষয়ে জানার জন্য ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলীদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, আমাদের এখান থেকে কোনো তথ্য দেওয়ার নিয়ম নাই। আমরা সব তথ্য রেল ভবনে পাঠিয়ে দেই। আপনার যা তথ্য দরকার সব রেল ভবন থেকেই পাবেন। সেখানে সারা দেশের সকল ট্রেনের সব ধরনের তথ্যই আছে।
অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার বিষয়ে জানার জন্য রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। তবে এখন যেহেতু জানলাম এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করব’।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে রেলওয়ের যাত্রী সংখ্যা আট কোটিরও বেশি যা পাঁচ বছর আগে ছিল ছয় কোটির মত। বর্তমানে সারা দেশে ৯০টির মত আন্তঃনগর ট্রেন টালু আছে। এছাড়াও ১৩২টি মেইল ট্রেইন ও ১২৬টি লোকাল ট্রেন চালু আছে। বর্তমানে রেলকে ঘিরে বেশকটি মেগা প্রকল্প চালু আছে। সেই সুবাদে সরকার ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের প্রতিটি জেলাকে রেলের আওতায় আনছে।
তবে রেলের এত উন্নতি হওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা খুশি হওয়ায় পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আমরা এত আধুনিক ট্রেন চালু করতে পারি কিন্তু নিরাপদ অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারি না। এই অব্যবস্থাপনার কারণে হয়ত বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।