আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকের ২৫-৩০ আসনে থাকছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নৌকা প্রতীক। আর ৮টি আসনে থাকছে নৌকা ও লাঙ্গল। বুধবার রাতে জাপার একাধিক সূত্র এতথ্য নিশ্চিত করেন। সূত্রটি জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটগতভাবে নির্বাচনের পথে আবারও জাতীয় পার্টি। জোটগতভাবে নির্বাচন ছাড়া জাপার প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও দলের কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বৈঠকটি রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৈঠকের বিষয় জানালেও বৈঠকটি কোথায় হয়েছে, বৈঠকে কি হয়েছে তা একবারেই গোপনীয় রাখতে নির্দেশনা রয়েছে। এমন তথ্য জানিয়েছেন জাপার সূত্রগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির একজন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তাকে আস্থায় নিতে পারছে না। এজন্য জাপার দুই সদস্য প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আগে বৈঠক করে জোটগতভাবে নির্বাচন কিভাবে করা যায়, নির্বাচনকে কিভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায়, কতটি আসনে জাপার লাঙ্গল থাকবে, কতটি আসনে লাঙ্গল বা নৌকা থাকবে না, এসব বিষয়ে লিখিত আকারে চুক্তির পর বিষয়টি আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর পরিষ্কার করবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা। তবে দলটির অপর একটি সূত্র জানিয়েছে বৈঠকে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের কাছে প্রায় ৫০টি আসন দাবি করে। এতে আওয়ামী লীগ নেতারা বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে জাপার প্রতিনিধি দলে অংশ নেয়া এক সদস্যের এক ঘনিষ্ট লোক জানান, বৈঠকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে ২৫ থেকে ৩০টি আসন পেতে পারে মহাজোটগতভাবে। আর ৮টি আসেন উম্মুক্ত থাকবে। এমন তথ্য জানান তিনি।
এর আগে মহাজোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে জাপার দলের প্রার্থীরা ইতিমধ্যে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহসচিব মুজিবুল হক চন্নুকে জানিয়েছেন। সেজন্য তারা চাপে রাখছেন পার্টির দুই শীর্ষ নেতাকে। এই চাপের কারণে গতকাল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এই বৈঠকের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ পার্টির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করার কথা রয়েছে। তবে দলের সব প্রার্থীই লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করবেন বলে মানবকণ্ঠকে জানিয়েছেন দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, তারা নির্বাচনের পরিবেশন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছে। এবারও জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে পারে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, উনি হয়তো আবেগে বলতে পারেন। আমরা তো জোট, মহাজোটের না।
গতকাল বুধবার রাজধানীর বনানীতে দলীয় চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে গণমাধ্যমের আলাপকালে এ কথা বলেন চুন্নু। মহাজোটে জাপা থাকবে তথ্যমন্ত্রীর এমন ইঙ্গিত প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, জানি না তিনি ইঙ্গিত দেন কীভাবে। কারণ মহাজোটে বা জোটে থাকতে হলে তো, ইসিকে চিঠি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জানাতে হবে। উনি হয়তো আবেগে বলতে পারেন, তবে আমরা তো জোট, মহাজোটের না। এককভাবে লাঙ্গল নিয়ে আমরা নৌকার সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছি। যুদ্ধ করবো, নির্বাচন যুদ্ধ হবে উনাদের সঙ্গে।
দলীয় সূত্র বলছে, এদিকে বেগম রওশন ছাড়া দ্বাদশ নির্বাচনের পথে জাতীয় পার্টি। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা গেছে রওশন অনুগত কয়েকজন নেতাকে। যদিও তারা প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। জাতীয় পার্টি কি জোটগতভাবে নির্বাচন করব না কি এককভাবে নির্বাচন করবে এমন প্রশ্নে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু মানবকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এককভাবে নির্বাচন, জোটগতভাবে না। এককভাবে নির্বাচন করলে দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হতে পারবে কি না এমন প্রশ্নে চুন্নু আরও বলেন, যাদের যোগ্যতা নেই তারা হতে পারবে না। আমি চাই এককভাবে নির্বাচন। কেননা আমার সঙ্গে জনগণ রয়েছে। আমার মনে হয় তাদের সঙ্গে জনগণ নেই, এই ভয় থেকে তারা এমন কথা বলছেন।
এদিকে ২০০৮ সাল থেকে সবশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে নবম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মহাজোট করেই অংশ নেয়। ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনে দশম সংসদ নির্বাচনে জোট না হলেও আসন সমঝোতা হয় দুই দলে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল এমন ৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। এসব আসনেই জিতে আসেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। এই সমঝোতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রওশন এরশাদের। দীর্ঘসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোট করে আসা জাতীয় পার্টি আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এককভাবে ২৮৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এ অবস্থায় দলের শীর্ষ নেতারা বিশেষ করে দলের কো-চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বর্তমান সংসদ সদস্যরা নৌকা প্রতীক এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে লড়াই করতে নারাজ।
তারা বলছেন, সমঝোতা হলেই ভোট হবে, নইলে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনে অংশ না নেয়া দলগুলোসহ নির্বাচনবিরোধী মানুষের শত্রু হয়েছি। এখন মাঠপর্যায়ে নৌকা প্রতীকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের শত্রু হতে চায় না।’ তিনি বলেন, ‘অতি সম্প্রতি পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলামের বাসায় কো-চেয়ারম্যানদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেই আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। আওয়ামী লীগ আসন সমঝোতার বিষয়ে পজিটিভ না হলে অধিকাংশই ভোট বর্জনের পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ চলছে।’
জাপার একাধিক কো-চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের শঙ্কা ও সরকারের বিরুদ্ধে বছরজুড়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করলেও শেষ পর্যন্ত ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দেয় জাতীয় পার্টি। তাই তফসিলের আগে মহাজোট ও আসন সমঝোতা সম্ভব হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী আসন বণ্টন হবেÑ সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আসন বণ্টন ইস্যুর সুরাহা না হওয়ায় চিন্তিত দলের শীর্ষ নেতারা। আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে ফয়সালা চান পার্টির নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগের কাছে ৫০টি আসন চাইলেও ৩৫টিতে রফা হলেও খুশি।