নারীদের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সময়ে সংসদে ১৫টি সংরক্ষিত নারী আসন রাখা হয়। এটি বর্তমানে ৫০টি আসনে উন্নীত হয়েছে। এসব আসন থেকে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে অনেকেই করেছেন সরাসরি নির্বাচন, হয়েছেন মন্ত্রীও। তেমনি সরাসরি নির্বাচন করতে আগ্রহী তিনজন সাংসদের সঙ্গে কথা বলেছেন মোহাম্মদ ওমর ফারুক
মাহজাবিন খালেদ: রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। বর্তমানে তিনি সংরক্ষিত আসনের জামালপুরের সাংসদ। বাবা ছিলেন এয়ার ফোর্সের অধিনায়ক এবং দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। চাচা ছিলেন ছয় বারের সফল সাংসদ এবং মন্ত্রী। দাদা ছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান। ছোট বেলা থেকেই রাজনীতির মধ্য দিয়েই বড় হন তিনি। কিন্তু কখনো রাজনীতি করার ইচ্ছে ছিল না। নানান সামাজিক কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। চাচা মারা যাওয়ার পর এলাকাবাসী তার মা’কে রাজনীতিতে আসতে অনুরোধ করলে তিনি মেয়ে মাহজাবিনকে আনেন রাজনীতিতে। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বর্তমানে তিনি পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটি ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মেম্বার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জামালপুরের সংরক্ষিত আসনের (আসন-৩১৮) একজন সংসদ সদস্য। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিরও সদস্য তিনি। রাজনীতি নিয়ে তিনি বলেন, একটা সময় রাজনীতি করার আমার কোনো ইচ্ছেই ছিল না, যদিও আমার পরিবারের পিছনের গল্প রাজনীতিতেই ছিল। আমার বাবা মারা যাওয়ার পরে মা আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল রাজনীতি থেকে। মা ভাবতেন আমার চাচা বা পরিবারে একজন রাজনীতি করছেন সেটাই ঠিক আছে। তবে, অমি অনেক আগে থেকেই অন্ধ শিশুদের নিয়ে কাজ করতাম। তখন রাজনীতি না করলেও সামাজিক কাজ করতাম। ২০১৪ সালে যখন নির্বাচন চলে আসলো তখন এলাকাবাসীর অনুরোধে অনেক ভেবে মনোনয়ন নিয়েছিলাম। কারণ, এমপি হয়ে মানুষের জন্য কাজের সুযোগটা আরও বেশি। তারপর সংরক্ষিত আসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে এমপি বানালেন। আমাকে কাজ করার সুযোগটা দিলেন।
সংরক্ষিত আসনের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এলাকায় আমাদের অনেক কাজ করার সুযোগ আছে, এর বাইরেও সরকারের উন্নয়ন প্রচার করা, মানুষের সমস্যা খুঁজে বের করা। মূল কাজটা হচ্ছে- মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখা। নারী সাংসদরা সহজেই মানুষের কাছে যেতে পারি, সবার সাথে কথা বলতে পারি এবং তারাও সুখ-দুঃখ শেয়ার করে। ফলে, মানুষকে কাছে নিতে পারি। আমি এখন পর্যন্ত একশ’রও বেশি উঠান বৈঠক করেছি। তাদের কাছ থেকে প্রচুর উত্সাহ পেয়েছি। নিজের এলাকা থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহ আছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অশ্যই আছে। আমি সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছি। কে না চায় সরাসরি নির্বাচন করতে। তবে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর। নেত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইবো। দল যদি মনে করে আমাকে দিয়ে কাজ হবে, তাহলেই সম্ভব।
অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী: পড়া অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হোন অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হওয়া, বিতর্ক করা, প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছিল তার শিক্ষাজীবন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘আমি রাসেল বলছি’ বইটি পড়েই নিজের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে তার। নিজের নানার কাছে বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবারকে ঘটনা শুনেই বেড়ে ওঠেন অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী।
তিনি বলেন, ভাবতাম এই হত্যাকাণ্ডের কেন বিচার হয়নি। তখন জানাশোনার পরিধি খুবই কম ছিল। তবে আমার জীবনের একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল আমি আইনজীবী হবো, হয়েছি এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলা রাষ্ট্রপক্ষের প্যানেল আইনজীবীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। রাজনীতি নিয়ে তিনি বলেন, আমি বিখ্যাত মানুষদের জীবনী পড়ি, তাদের জীবনী থেকে বুঝতে শিখি। ভালো কেউ বক্তব্য দিলে মনোযোগ দিয়ে শুনি। যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখে ভীষণভাবে অনুসরণ করি। আমি তার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখি। নারী আসনের একজন সাংসদ হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোন প্রতিবন্ধকতা পাইনি। আমি সবসময় নিজেকে মানুষ হিসেবে মনে করি। আমরা নারী পুরুষ ভেদাভেদ করতে চাই না। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী, তাদেরকে ফেলে রেখে তো একটা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব না। নারীকে উন্নয়নের মূল ধারায় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে।
নারীদের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যেই বঙ্গবন্ধুর আমলে শুরু করা ১৫টি আসনকে আ’লীগ সরকার এখন পর্যায়ক্রমে ৪৫ থেকে ৫০টিতে উন্নীত করেছে। সরাসরি বা নিজের এলাকায় নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের সরকার নারীবান্ধব দল। সংরক্ষিত আসন থেকে বেশ কয়েকজন সাংসদ এখন মন্ত্রীও হয়েছেন এবং দক্ষতার সাথে তারা দায়িত্ব পালনও করছেন। নেত্রী যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন তাহলে নির্বাচন করবো না কেন! তবে আমি মনোনয়ন চাইবো, বাকিটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা। আমার স্বপ্ন আছে। রাজনীতির বাইরেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করছেন ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, মাদকমুক্ত সমাজ, অন্ধ ছেলেমেয়েদের নিয়েও তিন বেশ কাজ করছেন।
আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী: সাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির সহ-সম্পাদক। রাজনীতির শুরুটা পরিবার থেকেই। শিক্ষাজীবনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বৃত্তি নিয়েই পড়াশোনা করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকে হয়তোবা রাজনীতি করেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, নেতা হতে। আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি শুধু ঋণ শোধের জন্য। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিরঋণী। আমার খুব দুঃসময়ে তিনি পাশে না দাঁড়ালে আমি এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না। আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত। তখন আমি স্নাতকের শিক্ষার্থী। টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ চালানো যাচ্ছিল না। আমি মাঝে মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বেশি করে জানতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাসায় যেতাম। সেখানে আমার মরহুম বাবার পরিচিতজনরা আমাকে বললেন (তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী) শেখ হাসিনার কাছে শিক্ষা বৃত্তির জন্য লিখিত আবেদন করতে। আবেদনের এক মাসের মধ্যে আমি বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে এক হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি পেলাম এবং এটি পরবর্তীতে দুই হাজার টাকা হয়। বিভিন্ন কারণে বঙ্গবন্ধুর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমার ভালোবাসা ও ঋণ রয়েছে। আমি এ ঋণ শোধ করতেই রাজনীতিতে প্রবেশ করি। আমি চাই সত্ভাবে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করতে। আমার বাবার দেওয়া শিক্ষা আর ধানমণ্ডি ৩২ আমাকে রাজনীতির প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে।
কেয়া চৌধুরী বলেন, আমি তৃণমূল রাজনীতি করি। সপ্তাহের ছয়দিনই থাকি এলাকায়। আর একদিন স্বামী সন্তানের কাছে। মানুষের জন্য কাজ করি। কাজের স্বচ্ছতা রাখি। আমি সব কাজের হিসেব সামাজিক মাধ্যমে দেই। আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, অবশ্যই হবিগঞ্জ থেকে চাইবো। তবে, নেত্রীর কাছে আমি যোগ্য কিনা সেটাও দেখতে হবে। নেত্রী যদি মনে করেন, আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি আসনটি আনতে পারবো তাহলে তিনি অবশ্যই আমাকে দিবেন। আশা করি সেই জায়গাটি আমি তৈরি করতে পেরেছি।
ছবি: আবুল বাশার
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, ০২ নভেম্বর ২০১৭
লেটেস্টবিডিনিউজ.কম/এসএফ