আজ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন

আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২২তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন। ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

এবার বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাজেট কিছুটা কাটছাট করে অনেকটা সাদামাটাভাবে সম্মেলন করতে যাচ্ছে দেশের প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটি। সাদামাটা বলা হলেও সম্মেলনকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মাঝে আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ইতোমধ্যে সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতি প্রসঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা দেশের মানুষকে স্বতঃস্ফূর্ত এই বার্তা দিতে চাই, আমরা জনগণের পাশে আছি, পাশে থাকবো। পরবর্তী নির্বাচনেও জনগণের পরামর্শ নিয়ে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে চায় আওয়ামী লীগ।

এদিকে বরাবরের মতো এবারো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে সাধারণ সম্পাদক নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন চলছে। এ পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই বহাল থাকবেন নাকি অন্য কেউ স্থলাভিষিক্ত হবেন- তা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে আলোচনার শেষ নেই। ওবায়দুল কাদের স্বপদে বহাল থাকলে টানা তিন মেয়াদে থাকায় তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হ্যাট্রিক করবেন। পরিবর্তন হলে এ পদে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নাম বিভিন্ন মহলে জোরালো আলোচনায় রয়েছে।

গত জাতীয় সম্মেলনের আগে ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেলেও এবার এখন পর্যন্ত কোনো নেতাকেই সেই সঙ্কেত দেয়া হয়নি বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

দলের ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল সাড়ে ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের পর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মঞ্চে আসন গ্রহণ করবেন। এরপরই আধঘণ্টা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন শেষে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করবেন দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া।

সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেবেন অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হবে। এবারের জাতীয় সম্মেলনে সারাদেশ থেকে প্রায় ৭ হাজার কাউন্সিলর এবং লক্ষাধিক ডেলিগেট ও নেতাকর্মী অংশ নেবেন।
শনিবার বিকেল ৩টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুরু হবে কাউন্সিল অধিবেশন। এই অধিবেশনে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হবে। দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে।

দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত সম্মেলনের তুলনায় এবার অনেকটা সাদামাটা সাজসজ্জার মধ্য দিয়েই সম্মেলন করা হচ্ছে। কেবল সম্মেলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছে নজরকাড়া সাজসজ্জা ও আলোর ঝলকানি। ব্যানার-ফেস্টুনও থাকবে কেবল উদ্যান ঘিরে। আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় ও দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে থাকছে আলোর ঝলকানি। প্রথা অনুযায়ী সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা ও সদস্য সচিব সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

সম্মেলন সফল করতে রাত-দিন নিরলস পরিশ্রম করছেন ১১টি উপকমিটির নেতারা। দফায় দফায় বৈঠক, দাওয়াতপত্র বিতরণ, গঠনতন্ত্র সংযোজন-বিয়োজন, ঘোষণাপত্র পরিমার্জন, মঞ্চ সাজসজ্জাসহ আনুষঙ্গিক সব কাজই সম্পন্ন করা হয়েছে। এ বছর বিদেশীদের দাওয়াত করা হচ্ছে না। তবে সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ১৪ দল, জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে দাওয়াত করা হয়েছে। ব্যয় কমাতে দুই দিনের সম্মেলন এবার এক দিনেই সম্পন্ন করা হচ্ছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০১৯ সালের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর। ওই সম্মেলনের বাজেট ছিল ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ৩০ লাখ টাকা কমিয়ে এবারের সম্মেলনের জন্য বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

জানা গেছে, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের মূল মঞ্চের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পর্বের জন্য তৈরি হচ্ছে আলাদা মঞ্চ। মূলমঞ্চে চার সারিতে চেয়ার সাজানো হয়েছে। প্রথম সারিতে বসবেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দ্বিতীয় সারিতে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সিনিয়র নেতা ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাকি দু’টিতে বসবেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। মোট ১২০টি চেয়ার রাখা হবে। পদ্মা সেতুর ওপরে নৌকার আদলে তৈরি ৮০ ফুট বাই ৪৪ ফুট মঞ্চ তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। মূল মঞ্চের উচ্চতা হবে ৭ ফুট। এ ছাড়াও পর্যাপ্ত পরিমাণ এলিডি মনিটর থাকবে, যেখানে সম্মেলনের কার্যক্রম দেখা যাবে।

এদিকে আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে দলের সভাপতি পদে যে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, সেটি নিশ্চিত। সেজন্য এখন সবার আগ্রহ-আলোচনা সাধারণ সম্পাদক পদ ঘিরেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক সদস্য জানান, প্রথমবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর তৎকালীন সদস্য ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।

সম্মেলনে তিনি কণ্ঠভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেও বিষয়টি আগে থেকেই অনেকটা চূড়ান্ত ছিল। ২১তম জাতীয় সম্মেলনেও অনেকটা চূড়ান্ত ছিল সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন ওবায়দুল কাদের। তবে এবারের সম্মেলনে কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক তা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছ থেকে কোনো ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে পরিবর্তনেরও কোনো আভাস দেয়া হয়নি।

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রায় এক ডজন নেতার নাম বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনায় এলেও বর্তমান সাধারণ সম্পাদকসহ পাঁচজন নেতাই এ পদের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। ওই পাঁচ নেতার অনুসারীরা মনে করেন, এদের মধ্য থেকে যে কেউ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পেলে আওয়ামী লীগের আগামী দিনের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অবস্থান আরো পোক্ত হবে। অবশ্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুসারিরা নিজ নিজ নেতাকে আগামী দিনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চান। সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আজকের জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেবেন তারা।

সূত্র আরও জানায়, সম্মেলনে নবীণ-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি গঠনের চিন্তা আছে আওয়ামী লীগের। গত ২১তম সম্মেলনে যারা মূল্যায়িত হননি এমন নব্বই দশকের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা এবং ওয়ান ইলেভেনের সময়কারের পরীক্ষিত তরুণরা কমিটিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আর গত সম্মেলনে কমিটিতে ঠাই পাওয়া নতুন নেতাদের বিষয়ে জোরালোভাবে পর্যালোচনা চলছে। ৮১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী সংসদের মধ্যে দুটি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ আসতে পারে। দুজন পদোন্নতি পেয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হতে পারেন। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে একজন পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও গত তিন বছরে দলের জন্য কোনো নেতার কতটুকু ত্যাগ আছে, কারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে।

এ প্রসঙ্গে প্রবীণ রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মনে হয় না গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে সম্মেলন এলেই সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে আলোচনা বেশি হয়। সামনে নির্বাচন। অনেক হিসেবে নিকেশ আছে। ফলে পরিবর্তনের কোনো আভাস আপাতত নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্মেলন সামনে রেখে শেখ রেহেনা, জয় ও পুতুল আলোচনায় থাকেন। রাজনীতিতে আসা না আসা এটা অনেকটা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত। তারা আসলেতো বড় চমকই হবে।

অ্যাডভোকেট হুমায়ুন বলেন, গত কাউন্সিলে নবীণ-প্রবীণের উচ্ছ্বাস ঘটেছে। এবারও সব মিলিয়ে কমিটিতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় থাকবে। সর্বক্ষেত্রে নতুন আবহ সৃষ্টি হবে। নব্বই দশকের ছাত্র নেতৃত্ব, পেশাজীবীদের মধ্যে পরীক্ষিতরা সুযোগ পাবে।

দলে পরিবর্তন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, একটা পদে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সেটি হচ্ছে আমাদের পার্টির সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ছাড়া আমরা কেউ অপরিহার্য নই। তিনি এখনো আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য।

তিনি বলেন, আই এম নট এ পারফেক্ট লিডার। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের ভুলত্রুটি হতে পারে। বড় দলে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও কিছু থাকবে। আওয়ামী লীগ রুলিং পার্টি, একাধারে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় কিছু সমস্যা থাকে। যেমন-যিনি নেতৃত্বে আছেন তিনি থাকতে চান আবার নতুন কেউ পদে আসার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। দুই মিলে অনেক সময় কনফ্লিক্ট তৈরি হয়ে যায়। কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা হয়। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে একমাত্র আওয়ামী লীগই অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা করে।