রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যান রণক্ষেত্র

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের চন্দ্রিমা উদ্যানে যাওয়া বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।

এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক। এ ছাড়া পুলিশের ১০ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে বিএনপি উত্তরের যুগ্ম-আহ্বায়ক এজেএম শামসুল হকসহ ১২ জনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমান, আমিনুল ও পুলিশসহ অর্ধশতাধিক আহত, আটক ১২ জন। \”বিনা উসকানিতে হামলা\” বলছেন মির্জা ফখরুল, আর \”আত্মরক্ষার্থে ব্যবস্থা নিয়েছি\” বলছে পুলিশ।

ঘটনার জন্য পুলিশ-বিএনপি একে অপরকে দায়ী করছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিএনপির নেতাকর্মীরা অতর্কিত তাদের ওপর হামলা চালায়। আত্মরক্ষার্থে তারা ব্যবস্থা নিয়েছে। আর বিএনপি দাবি করেছে-সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল তাদের। ওই কর্মসূচিতে পুলিশ বিনা উসকানিতে নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঢাকা মহানগর বিএনপির নবগঠিত দুই কমিটির নেতাদের সঙ্গে কয়েক হাজার কর্মী সকাল ১০টার দিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে জড়ো হন। এরপর তারা দেখতে পান সংসদ ভবনের দিক থেকে উদ্যানের প্রবেশপথ বন্ধ। এ কারণে অনেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠের পাশের দেওয়াল টপকে জিয়ার মাজারে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পুলিশ তাদের বাধা দেয়।

এ সময় মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার আমিনুল হক নেতাকর্মীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। এতে নেতাকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে পুলিশ বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। নেতাকর্মীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরই মধ্যে নেতাকর্মীরা চন্দ্রিমা উদ্যানের ভেতরে চলে যান। কিছুক্ষণ পর তারা মিছিল নিয়ে জিয়ার মাজারের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ ফের কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে।

এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। এ পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এতে পুরো উদ্যান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে বিএনপির মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক ফেরদৌসি আহমেদ মিষ্টিসহ অর্ধশত আহত হন। আমিনুলের শরীরে গুলি লাগে। তার শরীরে রক্ত দেখা যায়। এ অবস্থায়ই নেতাকর্মীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন তিনি। আমানও নেতাকর্মীদের শান্ত করেন।

পরে পুলিশের ধাওয়ায় মুখে নেতাকর্মীদের অনেকে চন্দ্রিমা উদ্যানের সীমানার বাইরে বের হয়ে যান। প্রধান সড়কে গিয়ে তার মেট্রোরেলের কাজে নিয়োজিত কয়েকটিসহ পরিকল্পনা কমিশনের সচিবের গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী সাংবাদিকদের জানান, অফিসে যাওয়ার সময় চন্দ্রিমা উদ্যানের কাছে বিজয় সরণি মোড়ে হঠাৎ একদল লোক তার গাড়িতে আক্রমণ করে। তখন তিনি গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ বক্সে আশ্রয় নেন। এ সময় তার গাড়িটি ভাঙচুর করা হয়।

সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পর দুপুর ১২টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে যান এবং ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিনি বলেন, বিএনপির শান্তিপূর্ণ একটা কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। গুলি চালিয়েছে। নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা করেছে। এতে অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই। সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ জন্যই তারা এ ধরনের আচরণ করছে।

হট্টগোলের মধ্যে নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। শান্তিপূর্ণ একটা কর্মসূচি, নেতাকর্মীরা ফুল দিতে এসেছেন এবং জিয়ারত করবেন, সেখানে উসকানির তো প্রশ্নই ওঠে না। বরং পুলিশ নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।

এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা শিরিন সুলতানা, মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, সদস্য সচিব আমিনুল হক, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুসহ বিভিন্ন স্তরের নেতা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশের তেজগাঁও জোনের ডিসি শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা বিনা উসকানিতে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। আত্মরক্ষার্থে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তাছাড়া এ কর্মসূচি পালনে পুলিশের কোনো অনুমতি ছিল না। ঘটনার বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সি সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল। আগেও তারা এখানে এসে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু আজ (মঙ্গলবার) বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের পক্ষের উচ্ছৃঙ্খল কয়েকজন এসে হট্টগোল শুরু করে পুলিশের ওপর চড়াও হন। অতর্কিত হামলা করেন পুলিশের ওপর। এতে ৮ থেকে ১০ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, আমিনুল হকসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের দেখতে যান সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।

আজ রাজধানীর থানায় থানায় বিক্ষোভ : পুলিশের হামলার প্রতিবাদে আজ (বুধবার) ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের থানায় থানায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম। তিনি বলেন, শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে আসা নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের নির্দেশে পুলিশের নির্মম হামলা, গুলিবর্ষণ, কাঁদানে গ্যাস-রাবার বুলেট নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করা হবে।

তিনি জানান, বিএনপির ৭৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুলিশ ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক এজেএম শামসুল হক, কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা শাহজাহান সম্রাটসহ ১২ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। সংঘর্ষ চলাকালে পরিকল্পনা সচিবের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় সালাম বলেন, এটা সরকারের সাজানো ঘটনা। সরকারের লোকজন ভাঙচুর করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে, বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, শহিদুল ইসলাম বাবুল, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Scroll to Top