বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নেতা এম ইলিয়াস আলী ‘গুম’ হওয়ার ব্যাপারে বিস্ফোরক মন্তব্য করে আলোচনায় আসা দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিষয়ে করণীয় নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারক মহলে আলোচনা চলছে। আজ-কালের মধ্যেই এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
তবে এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আব্বাসের বিষয়ে করণীয় নিয়ে বিএনপির মধ্যে নানা আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ বলছেন, তাঁকে শোকজ করে বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত। আবার কারো মতে, তাঁকে দল থেকেই বহিষ্কার করা উচিত।
অবশ্য দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময় থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আব্বাস বিএনপির জন্য ‘লায়াবিলিটিজ নয়, অ্যাসেট’—এমন আলোচনাও দলটির মধ্যে আছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। সে কারণে ওই অংশ মনে করছে, চিঠি দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে সতর্ক করে দিলেই বিএনপির জন্য ভালো। দল থেকে তাঁকে বের করে দিলে লাভ কী! এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা মারা যাওয়ায় বিএনপি এমনিতেই কিছুটা নেতৃত্বের সংকটে পড়েছে। আব্বাস দলের অনেক পুরনো ও ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর একটি সমর্থকগোষ্ঠীও রয়েছে বিএনপিতে।
যদিও আব্বাসের প্রতি সহানুভূতিশীল অংশটি তাঁর পক্ষে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালাতে পারছে না। কারণ অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তারাও স্বীকার করে যে অত্যন্ত পুরনো ও ত্যাগী নেতা হওয়া সত্ত্বেও আব্বাস তিনটি ভুল করেছেন।
প্রথমত, ইলিয়াস ‘গুমের’ জন্য তিনি বিএনপিরই কতিপয় নেতাকে দায়ী করেছেন। এটি দলের বিরুদ্ধে গেছে। কারণ ৯ বছর ধরে বিএনপি বলে আসছে যে ইলিয়াস আলী ‘গুমের’ সঙ্গে সরকার জড়িত। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি জাতিসংঘে পর্যন্ত অভিযোগ করেছে। দ্বিতীয়ত, ‘আওয়ামী লীগ ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি’—আব্বাসের এমন বক্তব্যে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন দলটি লাভবান হয়েছে। তৃতীয় ভুল হিসেবে যুক্ত হয়েছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা না মেনে ১৮ এপ্রিল নিজের মতো সংবাদ সম্মেলন করেছেন মির্জা আব্বাস; যেখানে পুরো ঘটনার জন্য তিনি গণমাধ্যমকে দোষারোপ করেছেন। অথচ তারেক রহমানের নির্দেশনা
অনুযায়ী বক্তব্যের একটি খসড়া তৈরি করে দিয়েছিল বিএনপি; যেখানে ভুল-বোঝাবুঝি ও দুঃখ প্রকাশের মতো নমনীয় কিছু বক্তব্য ছিল।
কিন্তু জানা যায়, কিছুটা একগুঁয়ে স্বভাবের আব্বাস ওই বক্তব্য পড়তে রাজি হননি। তারেকের নির্দেশনায় তৈরি হওয়া বক্তব্য সংবাদ সম্মেলনে পাঠ না করে নিজের মতো সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। কিন্তু এতে তারেক রহমান আরো ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁর ব্যাপারে করণীয় নিয়ে তিন দিন ধরে স্থায়ী কমিটির প্রায় সব নেতার সঙ্গে তিনি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে আব্বাসের ঘনিষ্ঠ কয়েক নেতাকে তারেক দায়িত্ব দিয়েছেন বক্তব্যের জন্য তাঁকে ‘ভুল স্বীকার করতে’ রাজি করানোর জন্য। যদিও আলোচনা করে জানা যায়, সাবেক যুবদল ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ওই নেতারাও আব্বাসের এমন বক্তব্যে হতাশ হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এত বড় ভুল মির্জা আব্বাস কী করে করতে পারলেন। তাঁরা কেউ কেউ টেলিফোনে যোগাযোগ রাখলেও আব্বাসের বাসায় যাচ্ছেন না। কারণ তারেক রহমান ছাড়াও বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী এ মুহূর্তে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। ফলে আব্বাসের ঘনিষ্ঠরাও তাঁকে এড়িয়ে চলছেন। আব্বাসকে অবশ্য তাঁরা নীরব থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্য এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তাঁদের মতে, বিষয়টি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এখতিয়ারে। তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেবেন।
তবে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘দায়িত্বশীল পদে থেকে আব্বাসের হয়তো এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। তবে মানুষের তো ভুল হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘যদিও আমি মনে করি না যে আব্বাস ইচ্ছাকৃতভাবে এসব কথা বলেছেন। এ ছাড়া ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে তাঁর আবেগ রয়েছে, এটিও বিচেনায় নেওয়া উচিত।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের বিষয়ে আমাদের মন্তব্য করার অধিকার নেই। দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার রাখেন।’
গত ১৭ এপ্রিল এক ভার্চুয়াল সভায় দেওয়া বক্তব্যে মির্জা আব্বাস বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ‘গুমের’ জন্য বিএনপিরই কিছু নেতাকে দায়ী করেন। ওই নেতাদের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই ব্যক্তিদের অনেকেই চেনেন।’ তিনি এ-ও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি।’