বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় চলমান লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ বেশিদিন থাকবে না বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
গতকাল মঙ্গলবার (৫ জুলাই) রাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে এক বার্তায় প্রতিমন্ত্রী একথা বলেন। এ তথ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাব সব জায়গাতে পড়েছে। করোনার ধাক্কা যখন সবাই কাটিয়ে ওঠছিল তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বকে গভীর এক সংকটে ফেলেছে। এ সংকটে শুধু উন্নয়নশীল নয়, অনেক উন্নত দেশেও এর আঁচ লেগেছে। যুদ্ধের প্রভাব জ্বালানি মার্কেটকে চরম অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এতে আন্তর্জাতিক খাদ্যপণ্যের বাজারও বেসামাল। বৈশ্বিক এ সংকট আমাদেরও বিপদে ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ৫২ বিলিয়ন ডলার রফতানির অনন্য মাইলফলক অর্জন করেছে। অর্থাৎ গত একযুগে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে আমাদের শিল্পায়ন অতীতের সব সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ‘দিন বদলের ইশতেহারে’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবেন। সেই রূপকল্প আমরা বাস্তবায়ন করেছি। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যুদ্ধের কারণে হঠাৎ করেই কিছুটা ছন্দ পতন সব জায়গাতেই।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘জাপানের মতো উন্নত ও অর্থনৈতিভাবে সমৃদ্ধ দেশও তাদের সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষকে নিয়মিত বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে পারছে না। একই অবস্থা আরেক উন্নত দেশ অস্ট্রেলিয়ারও। ভারত-পাকিস্তানের কথা না হয় নাই বা বললাম। অর্থাৎ সবাইকে এ সংকটকালীন সময়ে রেশনিং করতে হচ্ছে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১৬০০ থেকে ১৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। সেখানে আমরা দিতে পারছি মাত্র ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর বেশি গ্যাস আমরা দিতে পারছি না কারণ আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে কৃষি ও শিল্পখাতকে। কৃষির জন্য সার অপরিহার্য। সার উৎপাদনেও আমাদের অনেক পরিমাণ গ্যাস দিতে হচ্ছে।’
বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস উৎপাদন অবস্থা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বাকি বৃহৎ অংশ এলএনজি আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ও গ্যাসের উৎপাদন ছিল মাত্র দৈনিক ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। সেখান থেকে আমরা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছিলাম দৈনিক ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত। ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমরা এ সক্ষমতায় গ্যাস উৎপাদন করেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করেছে, আমাদের খনিগুলোর রির্জাভ কমে যাওয়ার কারণে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, এলএনজি আমদানির জন্য কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমরা এলএনজি পাচ্ছি। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি আমদানি করতাম। করোনার আগে আমরা এক ইউনিট এলএনজি ৪ ডলারেও আমদানি করেছি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা ৪১ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এত উচ্চমূল্যে আমদানি করলে আমাদের অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপ তৈরি হবে।
তিনি বলেন, ‘শুধু গ্যাসের দামই না, বেড়েছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ডিজেল ব্যারেল প্রতি ৭৭ ডলার ছিল; সেটা এ বছরের জুনে ১৭১ ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান, উৎপাদন বাড়ানো এবং বিদ্যমান কূপগুলোতে আরও গভীরে খনন করে গ্যাসের অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে। এরই মধ্যে আগামী ৩ বছরের একটা আপগ্রেডেশন, ওয়ার্কওভারের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি যাতে করে ৪৬টি কূপ থেকে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নতুন করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে।’
নসরুল হামিদ বলেন, এ পরিস্থিতি খুব বেশিদিন থাকবে না আশা করি। এ বছরের মধ্যেই পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ভারত থেকে ১৬০০ মেগাওয়াট আমদানি করা বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের নিশ্চয় সবার মনে আছে ২০০৮ সালের আগে সারা দেশে দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। সেই কঠিন সময়ে আপনারা শেখ হাসিনার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এ সংকটকালীন সময়েও আপনাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বাস রাখতে বলব। এ সংকট আমরা সবাই মিলেই পার করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে সবার কাছে একটাই অনুরোধ, আসুন আমরা সবাই গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হই।’